১২-২০ নং আয়াতের তাফসীর:
এ আয়াতগুলোতে আহযাব অর্থাৎ খন্দকের যুদ্ধের কঠিন মুর্হূতে মুনাফিকরা ও যাদের অন্তরে ইসলামের ব্যাপারে সন্দেহ ছিল তারা আল্লাহ তা‘আলার এবং তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দেয়া সাহায্যের প্রতিশ্র“তিকে মিথ্যা মনে করেছিল এবং যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন টাল-বাহানা, ওজর পেশ করেছিল সে কথাই আলোচনা করা হয়েছে। এটা ছিল তাদের অভ্যন্তরীণ কুফরীর বহিঃপ্রকাশ। পরবর্তী পর্যায়ে যেসব মুনাফিক কার্যতঃ বাহ্যিকভাবে মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে শরীক ছিল তারা দুশ্রেণির; প্রথম শ্রেণিন যারা কিছু না বলেই পালাতে লাগল এবং বলতে লাগল
(وَإِذْ قَالَتْ طَّآئِفَةٌ مِّنْهُمْ يٰٓأَهْلَ يَثْرِبَ لَا مُقَامَ لَكُمْ فَارْجِعُوْا)
“তাদের মধ্য থেকে এক দল বলেছিল: হে ইয়াস্রিববাসী! এখানে তোমাদের কোন স্থান নেই, অতএব তোমরা ফিরে যাও”। আরেক শ্রেণিন যারা ছল-চাতুরী করে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আবেদন করল। তাদের প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَيَسْتَأْذِنُ فَرِيْقٌ مِّنْهُمُ النَّبِيَّ يَقُوْلُوْنَ إِنَّ بُيُوْتَنَا عَوْرَةٌ)
“আর তাদের মধ্যে এক দল নাবীর কাছে অব্যাহতি চেয়ে বলেছিল: আমাদের বাড়ি-ঘর অরক্ষিত।” আল্লাহ তা‘আলা তাদের এসব ছল-চাতুরীর স্বরূপ উদঘাটন করে দিয়েছেন যে, এসব মিথ্যা। আসলে এরা যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যেতে চায় । পরবর্তী কয়েক আয়াতে তাদের কুকর্ম ও মুসলিমদের সাথে শত্র“তা অতঃপর এদের করুণ ও মর্মন্তুদ পরিণতির বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
“يثرب” দ্বারা মদীনাকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ মদীনার পূর্ব নাম ছিল ইয়াসরিব। হাদীসে এসেছে: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন “স্বপ্নে আমাকে তোমাদের হিজরতের স্থান দেখানো হয়েছে। তা দুটি কঙ্করময় ভূমির মধ্যস্থলে অবস্থিত। আমার মনে হয়েছিল যে, ওটা হিজর হবে। কিন্তু না তা ইয়াসরিব। (সহীহ বুখারী হা: ৭/২৬৭, সহীহ মুসলিম হা: ৪/২০/১৭৭৯)
“الفتنة” দ্বারা দুটো অর্থ হতে পারে:
১. শির্ক:
অর্থাৎ মদীনা বা ওদের ঘরে যদি চারদিক থেকে শত্র“বাহিনী প্রবেশ করত এবং তাদের নিকট (মুনাফিকী) প্রস্তাব রাখত যে, তোমরা পুনরায় কুফরী ও শির্কের দিকে ফিরে এসো, তাহলে ওরা সামান্যও দেরী করত না এবং সে সময় ঘর অরক্ষিত হওয়ার কোন ওজর দেখাত না। বরং অবিলম্বে শির্কের প্রস্তাবকে গ্রহণ করত। উদ্দেশ্য এই যে, কুফর ও শির্কের প্রতি ওরা বড় আসক্ত এবং তার দিকে ওরা দ্রুত ধাবিত হয়।
২. বিদ্রোহ ও অন্ধ পক্ষপাতিত্ব করে যুদ্ধ:
অর্থাৎ শত্র“বাহিনী প্রবেশ করে ওদের সাথে মিলিত হয়ে ওদেরকে বিদ্রোহের জন্য প্ররোচিত করত, তাহলে ওরা অবশ্যই বিদ্রোহ করে বসত।
তবে এখানে ফিতনা অর্থ শির্ক এটাই অধিক গ্রহণযোগ্য।
(وَلَقَدْ كَانُوْا عَاهَدُوا اللّٰهَ مِنْ قَبْلُ)
‘অথচ এরাই পূর্বে আল্লাহ্র সাথে শপথ করেছিল’ এ আয়াতে যে অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে তা হল, মুসলিম বাহিনী যখন বদর প্রান্তরে বিজয়ী হয়েছিল এবং প্রচুর গনীমত লাভ করেছিল। তখন এ মুনাফিকরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছিল যে, তারা আর কখনো যুদ্ধ থেকে পিছপা হবে না। কিন্তু খন্দকের যুদ্ধের কঠিন মুহূর্তে সে ওয়াদা ঠিক রাখতে পারেনি। মুনাফিকরা যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ঐ সকল পলায়নকারী মুনাফিকদেরকে তিরস্কারের সাথে বলতে বলছেন যে, বলে দাও; তোমরা নিহত হবে বা মারা যাবে এ ভয়ে পলায়ন করলেও কোন উপকার হবে না, হয়তো দুনিয়াতে বেশ কয়েকদিন বেঁচে থাকতে পারবে কিন্তু তারপরও মৃত্যু বরণ করতে হবে, তখন বুঝতে পারবে যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা ও ওয়াদা দিয়ে তা ভঙ্গ করার পরিণাম কী।
তারপর নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আরো জানিয়ে দিতে বলছেন: যদি আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের কোন ক্ষতি চান বা কোন কল্যাণ চান তাহলে কেউ কি আছে, যে তা হতে রক্ষা করতে পারবে বা তা ঠেকাতে পারবে? না কক্ষনো নয়। সুতরাং কেন তোমরা মৃত্যুর ভয়ে জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করছ?
(قَدْ يَعْلَمُ اللّٰهُ الْمُعَوِّقِيْنَ مِنْكُمْ)
‘আল্লাহ খুব ভাল করেই জানেন তোমাদের মধ্যে কারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে বাধা দেয়’ الْمُعَوِّقِيْنَ অর্থ বাধাদানকারী, প্রতিহতকারী। অর্থাৎ যে সকল মুনাফিকরা মানুষকে যুদ্ধে যেতে বাধা দেয় আর যারা তাদের ভাইদেরকে যুুদ্ধের ময়দান থেকে চলে আসতে বলে তাও আল্লাহ তা‘আলা জানেন। মুকাতিল বলেন: তারা হল মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই ও তার সাথীরা।
এতে তিনটি বর্ণনা রয়েছে:
(১) এরা হল মুনাফিক, মু’মিনদেরকে তারা বলেছিল: মুহাম্মাদ ও তাঁর সাথীরা ধ্বংস হয়ে যাবে, অতএব আমাদের দলে চলে আসো।
(২) এরা হল বানু কুরাইযার ইয়াহূদী, তাদের মুনাফিক ভাইদেরকে বলেছিল: মুহাম্মাদকে ছেড়ে আমাদের কাছে চলে আসো, কেননা সে ধ্বংস হয়ে যাবে। আবূ সুফিয়ান জয়ী হলে তোমাদের কাউকে জীবিত রাখবে না।
(৩) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জনৈক সাহাবী যিনি যুদ্ধের ময়দানে তরবারী ও তিরন্দাজদের মাঝে ছিলেন তাকে তার সহোদর ভাই বলল: আমার কাছে চলে আসো, চারদিক থেকে তোমাদেরকে শত্র“রা বেষ্টন করে নিয়েছে। সে সাহাবী বলছিলেন: তুমি মিথ্যা বলেছ, আল্লাহ তা‘আলার শপথ আমি এ কথা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জানিয়ে দেব। সে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জানিয়ে দিতে গিয়ে দেখে ওয়াহীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে। (কুরতুবী)
“اَشِحَّةٌ” শব্দের অর্থ হল কৃপণ। অর্থাৎ তারা ছিল নফসের দিক দিয়ে, চেষ্টার দিক দিয়ে, ভালবাসার দিক দিয়ে এবং মু’মিনদেরকে সাহায্য করার দিক দিয়ে কৃপণ। আর তারা ছিল দুনিয়া প্রিয় ও মৃত্যুকে অপছন্দকারী।
(يَحْسَبُوْنَ الْأَحْزَابَ لَمْ يَذْهَبُوْا)
‘তারা ধারণা করে যে, এখনও সম্মিলিত শত্র“বাহিনী চলে যায়নি’ অর্থাৎ মুনাফিকরা তাদের কাপুরুষতার কারণে ধারণা করেছিল যে, শত্র“ বাহিনী এখনো চলে যায়নি। কিন্তু তারা চলে গিয়েছিল তবে বেশি দূর যায়নি। তারা মনে মনে কামনা করছিল যদি আবার আসে তাহলে তারা মারামারি থেকে বাঁচার জন্য পল্লী এলাকায় চলে যাবে। ফলে নিরাপদে থেকে যাবে, কোন সমস্যা হবে না, সেখানে বসে বসে পরিবেশ-পরিস্থিতির খবর নেবে ।
ওপরের আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, মুনাফিকরা ইসলামের জন্য যত ক্ষতিকর, কাফিরাও তত ক্ষতিকর নয়। তাই তাদের থেকে সাবধান থাকতে হবে, কারণ মুসলিমদের আভ্যন্তরীণ ক্ষতি করার জন্য তারাই যথেষ্ট।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. যত বড় বিপদই আসুক না কেন ঈমানের ওপর ধৈর্যধারণ করে অটল থাকতে হবে। ঈমান হারা হওয়া যাবে না।
২. যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা যাবে না এবং এর জন্য কোন ওজর পেশ করা যাবে না।
২. কেবল মুনাফিকরাই জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করে থাকে।
৩. অঙ্গীকার ভঙ্গ করা মুনাফিকের আলামত।
৪. মানুষকে একদিন না একদিন অবশ্যই মৃত্যু বরণ করতে হবে। কোন প্রাণীই চিরস্থায়ী নয়।
৬. সর্বপ্রকার কৃপণতা থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
৭. মুনাফিকরা ইসলাম ও মুসলিমদের আভ্যন্তরীণ শত্র“, এরা কাফিরদের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর।