হা-মীম সেজদাহ আয়াত ২৪
فَاِنْ يَّصْبِرُوْا فَالنَّارُ مَثْوًى لَّهُمْ ۚوَاِنْ يَّسْتَعْتِبُوْا فَمَا هُمْ مِّنَ الْمُعْتَبِيْنَ ( فصلت: ٢٤ )
Fa-iny yasbiroo fan Naaru maswal lahum wa iny-yasta'tiboo famaa hum minal mu'tabeen (Fuṣṣilat ৪১:২৪)
English Sahih:
So [even] if they are patient, the Fire is a residence for them; and if they ask to appease [Allah], they will not be of those who are allowed to appease. (Fussilat [41] : 24)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
এখন যদি তারা ধৈর্য ধারণ করে তবুও জাহান্নামই হবে তাদের আবাস, আর যদি তারা ক্ষমা প্রার্থনা করে তবুও তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে না। (হা-মীম সেজদাহ [৪১] : ২৪)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
এখন ওরা ধৈর্যশীল হলেও জাহান্নামই হবে ওদের আবাস এবং ওরা ক্ষমাপ্রার্থী হলেও ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে না। [১]
[১] এর আর একটি অর্থ এও করা হয়েছে যে, যদি তারা মানাতে (সন্তুষ্ট করতে) চায়, যাতে তারা জান্নাতে যেতে পারে, তবে (আল্লাহর) সন্তুষ্টি তারা কখনও লাভ করতে পারবে না। (আয়সারুত্ তাফাসীর, ফাতহুল ক্বাদীর) কেউ কেউ এর অর্থ করেছেন, তারা পুনরায় দুনিয়াতে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করবে, যা মঞ্জুর করা হবে না। (তফসীর ত্বাবারী) অর্থাৎ, তাদের চিরস্থায়ী ঠিকানা হল জাহান্নাম, তাতে ধৈর্য ধারণ করলে (তবুও রহম করা হবে না। যেমন, দুনিয়াতে কোন কোন সময় ধৈর্য ধারণকারীদের প্রতি মায়া-মমতা আসে) অথবা অন্য কোনভাবে সেখান থেকে বের হওয়ার প্রচেষ্টা করলেও, তাদেরকে ব্যর্থই হতে হবে।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
অতঃপর যদি তারা ধৈর্য ধারণ করে তবে আগুনই হবে তাদের আবাস। আর যদি তারা সস্তুষ্টি বিধান করতে চায় তবে তারা সন্তুষ্টিপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে না।
3 Tafsir Bayaan Foundation
অতঃপর যদি তারা ধৈর্যধারণ করে তবে আগুনই হবে তাদের আবাস এবং যদি তারা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে চায়, তবুও তারা আল্লাহর সন্তোষপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে না।
4 Muhiuddin Khan
অতঃপর যদি তারা সবর করে, তবুও জাহান্নামই তাদের আবাসস্থল। আর যদি তারা ওযরখাহী করে, তবে তাদের ওযর কবুল করা হবে না।
5 Zohurul Hoque
কাজেই তারা যদি অধ্যবসায় করে তাহলে আগুনই হবে তাদের অবস্থানস্থল, আর যদি তারা সদয়তা চায় তাহলে তারা নুগ্রহপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে না।
6 Mufti Taqi Usmani
এখন তারা ধৈর্য ধারণ করলেও জাহান্নামই হবে তাদের ঠিকানা আর যদি অজুহাত প্রদর্শন করে, তবে যাদের অজুহাত গৃহীত হবে, তাদের অন্তর্ভুক্ত এদেরকে করা হবে না।
7 Mujibur Rahman
এখন তারা ধৈর্য ধারণ করলেও জাহান্নামই হবে তাদের আবাস স্থল এবং তারা অনুগ্রহ চাইলেও অনুগ্রহ প্রাপ্ত হবেনা।
8 Tafsir Fathul Mazid
১৯-২৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
(وَیَوْمَ یُحْشَرُ اَعْدَا۬ئُ اللہِ...... فَاِنْ یَّصْبِرُوْا فَالنَّارُ مَثْوًی لَّھُمْ)
এ আয়াতসমূহে কিয়ামতের মাঠে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তাদেরই বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করবে-আল্লাহ তা‘আলা এ সম্পর্কেই আলোকপাত করেছেন। অতঃপর তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম। দুনিয়াতে মানুষ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কত সেবাযতœ করে থাকে। কোন অঙ্গ আঘাতপ্রাপ্ত হলে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়াসহ আর কত কি করে। কিন্তু এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের যদি সৎ ব্যবহার না করা হয়, যদি অসৎ কাজে ব্যবহার করা হয় তাহলে সে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মানুষের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(وَّنَسُوْقُ الْمُجْرِمِيْنَ إِلٰي جَهَنَّمَ وِرْدًا )
“এবং অপরাধীদেরকে তৃষ্ণাতুর অবস্থায় জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাব।” (সূরা মারইয়াম ১৯ : ৮৬)
আর তথায় তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(اَلْيَوْمَ نَخْتِمُ عَلٰٓي أَفْوَاهِهِمْ وَتُكَلِّمُنَآ أَيْدِيْهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوْا يَكْسِبُوْنَ )
“আজ আমি এদের মুখে মোহর মেরে দেব, এদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং এদের পা সাক্ষ্য দেবে যা তারা করত সে সম্পর্কে।” (সূরা ইয়া-সীন ৩৬ : ৬৫)
তখন অপরাধিরা তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ধিক্কার প্রদান করবে এবং বলবে : তোমরা কেন আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করছ? তোমরা দূর হও, তোমরা চুপ করো ইত্যাদি। যেমন হাদীসে বলা হয়েছে।
আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হেসে উঠলেন এবং সাহাবাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন : তোমরা কি জানো কী কারণে আমি হেসেছি? তারা বলল : হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল! আপনি কি কারণে হাসলেন? উত্তরে তিনি বললেন : কিয়ামতের দিন বান্দা কর্তৃক তার রবের সাথে ঝগড়া করার কথা মনে করে আমি বিষ্ময়বোধ করছি। বান্দা বলবে : হে আমার প্রতিপালক! আপনি কি আমার সঙ্গে অঙ্গীকার করেননি যে, আপনি আমার ওপর জুলুম করবেন না? আল্লাহ তা‘আলা জবাবে বলবেন : হ্যাঁ, সে বলবে : আমিতো আমার আমলের ওপর আমার নিজের সাক্ষ্য ছাড়া আর কারো সাক্ষ্য কবূল করব না। তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন : আমি এবং আমার সম্মানিত ফেরেশতারা কি সাক্ষী হিসেবে যথেষ্ট নয়? কিন্তু সে বারবার এ কথাই বলতে থাকবে। তখন আল্লাহ তা‘আলা তার মুখে মোহর লাগিয়ে দেবেন এবং তার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে যে, সে কী করেছে। তখন সে তাদেরকে তিরস্কার করে বলবে : তোমরা চুপ করো, আমি তো তোমাদেরকে রক্ষা করার জন্যই তর্ক করছিলাম। (সহীহ মুসলিম হা. ২৯৬৯)
অন্য এক হাদীসে বলা হয়েছে, আবূ মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বলেন : কাফির ও মুনাফিক্বদেরকে হিসাবের জন্য ডাকা হবে। তিনি তাদের প্রত্যেকের সম্মুখে তাদের কৃতকর্ম পেশ করবেন। তাদের প্রত্যেকে শপথ করে তার নিজের কৃতকর্ম অস্বীকার করবে এবং বলবে : হে আমার প্রতিপালক! আপনার ইজ্জতের শপথ করে বলছি : আপনার ফেরেশতারা এমন কিছু লিখে রেখেছে যা আমি কখনো করিনি। ফেরেশতারা বলবেন : তুমি কি অমুক দিন অমুক জায়গায় অমুক কাজ করনি? সে উত্তরে বলবে : হে আমার প্রতিপালক! আপনার মর্যাদার শপথ! আমি এ কাজ কখনো করিনি। অতঃপর তার মুখে মোহর লাগিয়ে দেয়া হবে এবং তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। সর্বপ্রথম তার ডান উরু কথা বলবে। (ইবনু জারীর-ত্ববারী- ২৩/১৭)
সুতরাং মানুষ যে-কোন স্থানে যে-কোন অন্যায় অথবা ভাল কাজ যাই করুক না কেন আল্লাহ তা‘আলা তা সম্যক অবগত রয়েছেন। তিনি সব কিছুই জানেন, শুনেন ও দেখেন।
(تَعْمَلُوْنَ....... وَمَا كُنْتُمْ تَسْتَتِرُوْنَ) শানে নুযূল :
ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : বাইতুল্লাহর পার্শ্বে তিনজন লোক ঝগড়া করছিল। দু’জন কুরাইশ গোত্রের এবং একজন সাক্বীফ গোত্রের অথবা এর বিপরীত। তাদের একজন বলল : তোমরা কি মনে করো যে, আমরা যা বলি আল্লাহ তা‘আলা তা শুনেন? অন্যজন উত্তর দিলো, আমরা যা উচ্চকণ্ঠে বলি তা শুনেন কিন্তু যা চুপিচুপি বলি তা শুনেন না। তৃতীয় জন বলল : যদি তিনি আমাদের উচ্চৈঃস্বরের কথা শুনতে পান তাহলে আমরা যা আস্তে আস্তে বলি তাও তিনি শুনেন। তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮১৬-১৭, সহীহ মুসলিম হা. ২৭৭৫)
অন্য বর্ণনায় ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : একদা আমি কাবার আস্তিনে আচ্ছন্ন ছিলাম। এমন সময় তিনজন ব্যক্তি আগমন করল। তাদের পেটে চর্বি ছিল অনেক কিন্তু বুদ্ধি ছিল কম। তারা কিছু কথা বলল, আমি তা বুঝতে পারলাম না।
তাদের একজন বলল : তোমরা কি জান না আল্লাহ আমাদের কথা শুনেন। অপরজন বলল, আমরা আওয়াজ উঁচু করলে আল্লাহ তা‘আলা শুনতে পান, আর আওয়াজ উঁচু না করলে শুনতে পাননা। অপরজন বলল, যদি আল্লাহ কিছু শুনেন তাহলে সব কথাই শুনেন। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন : আমি একথা যখন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে উল্লেখ করলাম তখন এ আয়াত নাযিল হয়। (তিরমিযী হা. ৩২৪৯, সহীহ)
(وَذٰلِكُمْ ظَنُّكُمُ الَّذِيْ ظَنَنْتُمْ بِرَبِّكُمْ)
“তোমাদের প্রতিপালক সম্বদ্ধে তোমাদের এ ধারণাই তোমাদের ধ্বংস করেছে” অর্থাৎ আল্লাহর ব্যাপারে এরূপ ধারণা করার কারণে তোমরা বেশি বেশি অপরাধ করেছ। ফলে তোমাদের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে গেছে। হাদীসে এসেছে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ভাল ধারণা না নিয়ে যেন কেউ মারা না যায়। কেননা যে জাতি তাদের প্রতিপালকের ব্যাপারে খারাপ ধারণা করেছে তিনি তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। (সহীহ মুসলিম হা. ২৮৭৭)
সুতরাং আমরা প্রকাশ্য ও গোপনে যা কিছু করি সব আল্লাহ তা‘আলা দেখেন ও জানেন। তাঁর কাছে কোন কিছু অস্পষ্ট নয়। তাই আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল পাপ কাজ বর্জন করা উচিত।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. কিয়ামতের মাঠে আল্লাহ তা‘আলার শত্র“দেরকে জাহান্নামের সম্মুখে উপস্থিত করা হবে।
২. কিয়ামতের মাঠে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে।
৩. অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে কথা বলার ক্ষমতা দেয়া হবে।
৪. সর্বপ্রথম কথা বলবে মানুষের ডান উরু।
৫. শাস্তি আসার পর ধৈর্য ধারণ করাতে কোনই লাভ নেই বরং তার পূর্বেই ঈমান আনতে হবে।
৬. আল্লাহ তা‘আলা মানুষের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল কিছুই জানেন।
9 Fozlur Rahman
(এখন) যদি তারা কষ্ট সহ্য করে তবুও জাহান্নামই তাদের আবাসস্থল থাকবে; আর যদি (আল্লাহর) অনুগ্রহ পেতে চায় তাহলে (তাঁর) অনুগ্রহ পাবে না।
10 Mokhtasar Bangla
২৪. অতএব, যাদের বিপক্ষে তাদের কান, চোখ ও ত্বক সাক্ষ্য প্রদান করেছে তারা যদি ধৈর্য ধারণ করে তো করলো। নচেৎ তারা যদি শাস্তি থেকে মুক্ত হতে চায় কিংবা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে তবে তারা তা অর্জন করতে পারবে না। আর না তারা আদৗ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।
11 Tafsir Ibn Kathir
১৯-২৪ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ এই মুশরিকদেরকে বলে দাও- কিয়ামতের দিন তাদেরকে জাহান্নাম অভিমুখে সমবেত করা হবে এবং জাহান্নামের রক্ষক তাদেরকে একত্রিত করবেন। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ
وَ نَسُوْقُ الْمُجْرِمِیْنَ اِلٰى جَهَنَّمَ وِرْدًا
অর্থাৎ “আমি অপরাধীদেরকে জাহান্নামের দিকে কঠিন পিপাসার্ত অবস্থায় হাঁকিয়ে নিয়ে যাবো।”(১৯:৮৬) তাদেরকে জাহান্নামের ধারে দাঁড় করিয়ে দেয়া হবে এবং তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, দেহ, কর্ণ, চক্ষু এবং ত্বক তাদের আমলগুলোর সাক্ষ্য প্রদান করবে। তাদের পূর্বের ও পরের সমস্ত দোষ প্রকাশিত হয়ে পড়বে। দেহের প্রতিটি অঙ্গ বলে উঠবেঃ “সে আমার দ্বারা এই গুনাহ করেছে।” তখন সে নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে ভৎসনা করে বলবেঃ “কেন তোমরা আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করছো?” তারা উত্তরে বলবেঃ “আমরা আল্লাহ তাআলার নির্দেশ পালন করছি মাত্র। তিনি আমাদেরকে কথা বলার শক্তি দান করেছেন। সুতরাং আমরা সত্য সত্য কথা শুনিয়ে দিয়েছি। তিনিই তোমাদেরকে প্রথমে সৃষ্টিকারী। তিনিই সবকিছুকে বাকশক্তি দান করেছেন। সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধাচরণ এবং তার হুকুমের অবাধ্যাচরণ কে করতে পারে?
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) হেসে উঠেন। অতঃপর তিনি বললেনঃ “আমি কেন হাসলাম তা তোমরা আমাকে জিজ্ঞেস করলে না যে?” সাহাবীগণ (রাঃ) তখন বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনি হাসলেন কেন?" উত্তরে তিনি বললেন, কিয়ামতের দিন বান্দার তার প্রতিপালকের সাথে ঝগড়ার কথা মনে করে আমি বিস্ময়বোধ করছি। বান্দা বলবেঃ “হে আমার প্রতিপালক! আপনি কি আমার সঙ্গে অঙ্গীকার করেননি যে, আপনি আমার উপর যুলুম করবেন না?আল্লাহ তা'আলা জবাবে বলবেনঃ “হ্যা (অবশ্যই করেছিলাম)।” সে বলবেঃ “আমি তো আমার আমলের উপর আমার নিজের ছাড়া আর কারো সাক্ষ্য কবুল করবে না। তখন আল্লাহ তাআলা বলবেনঃ “আমি এবং আমার সম্মানিত ফেরেশতারা কি সাক্ষ্য দেয়ার জন্যে যথেষ্ট নই?" কিন্তু সে বারবার তার একথাই বলতে থাকবে। তখন আল্লাহ তা'আলা সমস্ত জ্জতের জন্যে তার মুখে মোহর লাগিয়ে দিবেন এবং তার। দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে বলা হবেঃ “সে যা কিছু করেছে তার সাক্ষ্য তোমরা প্রদান কর।” তারা তখন পরিষ্কারভাবে সত্য সাক্ষ্য দিয়ে দিবে। সে তখন। তাদেরকে তিরস্কার করে বলবেঃ “আমি তো তোমাদেরকেই রক্ষা করার জন্যে তর্ক করছিলাম।” (এ হাদীসটি হাফিয আবু বকর আল বাযযায় (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম মুসলিম (রঃ) ও ইমাম নাসাঈ (রঃ) এটা তাখরীজ করেছেন)
হযরত আবূ মূসা আশআরী (রাঃ) বলেনঃ “কাফির এবং মুনাফিকদেরকে হিসাবের জন্যে ডাক দেয়া হবে। তিনি তাদের প্রত্যেকের সামনে তার কৃতকর্ম পেশ করবেন। তাদের প্রত্যেক ব্যক্তি শপথ করে করে নিজের কৃতকর্ম অস্বীকার করবে এবং বলবেঃ “হে আমার প্রতিপালক! আপনার ফেরেশতারা এমন কিছু লিখে রেখেছেন যা আমি কখনো করিনি। ফেরেশতারা বলবেনঃ “তুমি কি অমুক দিন অমুক জায়গায় অমুক আমল করনি?” সে উত্তরে বলবেঃ “হে আমার প্রতিপালক! আপনার মর্যাদার শপথ! আমি এ কাজ কখনো করিনি।” অতঃপর তার মুখে মোহর লাগিয়ে দেয়া হবে এবং দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করবে। সর্বপ্রথম তার ডান উরু কথা বলবে।” (এটা ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন কাফিরের সামনে তার কৃত মন্দ আমলগুলো পেশ করা হবে। সে তখন ওগুলো অস্বীকার করবে এবং তর্ক-বিতর্ক শুরু করে দিবে। তখন আল্লাহ তা'আলা বলবেনঃ “এই যে তোমার প্রতিবেশীরা তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছে?” সে বলবেঃ “তারা মিথ্যা বলছে।” মহান আল্লাহ বলবেনঃ “এই যে এরা তোমার পরিবারবর্গ, এরা সাক্ষ্য দিচ্ছে? সে উত্তর দিবেঃ “এরাও সবাই মিথ্যাবাদী।” আল্লাহ তা'আলা তখন তাদেরকে শপথ করাবেন। তখন তারা শপথ করবে। তথাপি সে অস্বীকারই করবে। আল্লাহ তাআলা তখন তাদেরকে নীরব করবেন এবং স্বয়ং তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দান করবে এবং তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।” (এ হাদীসটি হাফিয আবুল ইয়ালা (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
বর্ণিত আছে যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) ইবনুল আরাক (রঃ)-কে বলেনঃ “কিয়ামতের দিন একটি সময় তো এমন হবে যে, কাউকেও কথা বলার অনুমতি দেয়া হবে না এবং কোন ওযর-আপত্তিও শুনা হবে না। অতঃপর যখন কথা বলার অনুমতি দেয়া হবে তখন বান্দা ঝগড়া ও তর্ক-বিতর্ক করতে শুরু করবে এবং স্বীয় কৃতকর্মকে অস্বীকার করে বসবে। তারা মিথ্যা শপথ করবে। অবশেষে তাদের মুখে মোহর লাগিয়ে দেয়া হবে। সুতরাং তাদের মুখ বন্ধ হয়ে যাবে। তখন তাদের ত্বক, চক্ষু, হাত, পা ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করবে। অতঃপর তাদের মুখ খুলে দেয়া হবে। তখন তারা তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার কারণে তিরস্কার করবে। তারা তখন বলবেঃ “আল্লাহ, যিনি সবকিছুকে বাকশক্তি দিয়েছেন তিনি। আমাদেরকেও বাকশক্তি দিয়েছেন। তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন প্রথমবার এবং তাঁর নিকট তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।' তখন মুখও স্বীকার করে নিবে।” (এটা ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত রাফে আবুল হাসান (রঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, স্বীয় কৃতকর্ম অস্বীকার করার কারণে তার জিহ্বা এতো মোটা করে দেয়া হবে যে, ওটা একটা কথাও বলতে পারবে না। তখন দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে সাক্ষ্য দিতে বলা হবে। তারা প্রত্যেকেই তখন নিজ নিজ আমলের কথা বলে দিবে। কর্ণ, চক্ষু, ত্বক, লজ্জাস্থান, হাত, পা ইত্যাদি সবাই সাক্ষ্য দিবে। (এটাও ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
এর অনুরূপ আরো বহু হাদীস ও আসার সূরায়ে ইয়াসীনের নিম্নের আয়াতের তাফসীরে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং এখানে পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। আয়াতটি হলোঃ
اَلْیَوْمَ نَخْتِمُ عَلٰۤى اَفْوَاهِهِمْ وَ تُكَلِّمُنَاۤ اَیْدِیْهِمْ وَ تَشْهَدُ اَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوْا یَكْسِبُوْنَ
অর্থাৎ “আমি আজ তাদের মুখ মোহর করে দিবো, তাদের হস্ত কথা বলবে আমার সাথে এবং তাদের চরণ সাক্ষ্য দিবে তাদের কৃতকর্মের।”(৩৬:৬৫)।
হযরত জাবির ইবনে আবদিল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন আমরা সমুদ্রের হিজরত হতে ফিরে আসি তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) একদা আমাদেরকে বললেনঃ “তোমরা হাবশা দেশে (আবিসিনিয়ায়) বিস্ময়কর ঘটনা কিছু দেখে থাকলে বর্ণনা কর।” তখন একজন যুবক বললোঃ “একদা আমরা সেখানে বসে আছি এমন সময় তাদের আলেমদের একজন বৃদ্ধা মহিলা মাথায় একটি কলসি নিয়ে আমাদের পার্শ্ব দিয়ে গমন করে। তাদের একজন যুবক তাকে ধাক্কা দেয়। ফলে সে পড়ে যায় এবং কলসিটি ভেঙ্গে যায়। তখন ঐ বৃদ্ধা মহিলাটি উঠে ঐ যুবকটির দিকে দৃষ্টিপাত করে বললোঃ “ওরে প্রতারক! তুই এর পরিণাম তখনই জানতে পারবি যখন আল্লাহ তাআলা স্বীয় কুরসীর উপর সমাসীন হবেন এবং তার বান্দাদেরকে একত্রিত করবেন। ঐ সময় তাদের হাত, পা তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করবে এবং প্রত্যেকের প্রত্যেকটি আমল প্রকাশিত হয়ে পড়বে। ঐদিন তোর এবং আমার মধ্যে ফায়সালা হয়ে যাবে।” একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “বৃদ্ধা মহিলাটি সত্য কথাই বলেছে, আল্লাহ তা'আলা ঐ সম্প্রদায়কে কিভাবে পবিত্র করবেন যাদের দুর্বলদের প্রতিশোধ সবলদের হতে গ্রহণ না করবেন?” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এটা এই সনদে গারীব)
ইবনে আবিদ দুনিয়া (রঃ) এই রিওয়াইয়াতটিই অন্য সনদে বর্ণনা করেছেন। যখন বান্দা স্বীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দানের কারণে ভসনা। করবে তখন তারা উত্তর দিতে গিয়ে এ কথাও বলবেঃ “তোমাদের আমলগুলো আসলে গোপন ছিল না। আল্লাহ তা'আলার দৃষ্টির সামনে তোমরা কুফরী ও অবাধ্যাচরণের কাজে লিপ্ত থাকতে এবং কিছুই পরোয়া করতে না। কেননা, তোমরা মনে করতে যে, তোমাদের বহু কাজ আল্লাহর নিকট গোপন থাকছে। এই মিথ্যা ধারণাই তোমাদেরকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। তাই আজ তোমরা ধ্বংস হয়ে গেছে।”
হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “একদা আমি কাবা শরীফের পর্দার আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম। এমতাবস্থায় তথায় তিনজন লোক আসলো, যাদের পেট ছিল বড় এবং জ্ঞান ছিল কম। তাদের একজন বললোঃ “আচ্ছা বলতো, আমরা যে কথা বলছি তা কি আল্লাহ শুনতে পাচ্ছেন?” দ্বিতীয়জন বললোঃ “আমরা উচ্চস্বরে কথা বললে তিনি শুনতে পান এবং নিম্ন স্বরে কথা বললে তিনি শুনতে পান না।” তৃতীয় জন বললোঃ “তিনি কিছু শুনতে পেলে সবই শুনতে পান।” আমি এসে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট ঘটনাটি বর্ণনা করলাম। তখন আল্লাহ তা'আলা নিম্নের আয়াতগুলো অবতীর্ণ করেনঃ
وَ مَا كُنْتُمْ تَسْتَتِرُوْنَ اَنْ یَّشْهَدَ عَلَیْكُمْ سَمْعُكُمْ وَ لَاۤ اَبْصَارُكُمْ وَ لَا جُلُوْدُكُمْ ـ ـ ـ مِنَ الْخٰسِرِيْنَ ـ
অর্থাৎ “তোমরা কিছু গোপন করতে না এই বিশ্বাসে যে, তোমাদের কর্ণ, চক্ষু এবং ত্বক তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে না .......... ফলে তোমরা হয়েছে ক্ষগ্রিস্ত।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম মুসলিম (রঃ) ও ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত বাহ্য ইবনে হাকীম (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি তাঁর পিতা হতে এবং তিনি তাঁর দাদা হতে বর্ণনা করেছেন যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে এমন অবস্থায় আহ্বান করা হবে যে, তোমাদের মুখের উপর মোহর মারা থাকবে। তোমাদের মধ্যে কারো আমল সর্বপ্রথম যে (অঙ্গ) প্রকাশ করবে তা হবে তার উরু ও স্কন্ধ।” (এ হাদীসটি আবদুর রাযযাক (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
মা’মার (রঃ) বলেন যে, হযরত হাসান (রঃ) وَ ذٰلِكُمْ ظَنُّكُمُ الَّذِیْ ظَنَنْتُمْ بِرَبِّكُمْ اَرْدٰىكُمْ পাঠ করার পরে বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ “আমার বান্দা আমার সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে, আমি তার সাথে ঐ ব্যবহারই করে থাকি। আর যখন সে আমাকে ডাকে আমি তখন তার সাথেই থাকি।” হযরত হাসান (রঃ) এটুকু বলার পর কিছুক্ষণ চিন্তা করে আবার বলতে শুরু করেনঃ আল্লাহ সম্পর্কে যে ব্যক্তি যে ধরিণা করে তার আমলও ঐরূপই হয়ে থাকে। মুমিন আল্লাহর প্রতি ভাল ধারণা রাখে বলে তার আমলও ভাল হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে কাফির ও মুনাফিক আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করে বলে তার আমলও মন্দ হয়। অতঃপর তিনি বলেন যে, আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেনঃ وَ مَا كُنْتُمْ تَسْتَتِرُوْنَ اَنْ یَّشْهَدَ عَلَیْكُمْ سَمْعُكُمْ وَ لَاۤ اَبْصَارُكُمْ ـ ـ ـ ـ ـ ـ وَ ذٰلِكُمْ ظَنُّكُمُ الَّذِیْ ظَنَنْتُمْ بِرَبِّكُمْ اَرْدٰىكُمْ অর্থাৎ “তোমরা কিছু গোপন করতে না এই বিশ্বাসে যে, তোমাদের কর্ণ, চক্ষু এবং ত্বক তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে না ........ তোমাদের প্রতিপালক সম্বন্ধে তোমাদের এই ধারণাই তোমাদের ধ্বংস এনেছে। ফলে তোমরা ধ্বংস হয়েছে।”
হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের কেউ যেন এই অবস্থা ছাড়া মৃত্যু বরণ না করে যে, আল্লাহর প্রতি তার ধারণা ভাল রয়েছে। কারণ যে সম্প্রদায় আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা রেখেছে আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন।” অতঃপর তিনি ... وَ ذٰلِكُمْ ظَنُّكُمُ الَّذِیْ ظَنَنْتُمْ بِرَبِّكُمْ -এ আয়াতটিই তিলাওয়াত করেন। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
এরপর প্রবল প্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ এখন তারা ধৈর্যধারণ করলেও জাহান্নামই হবে তাদের আবাস এবং তারা অনুগ্রহ চাইলেও তারা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হবে না। অর্থাৎ জাহান্নামীদের জাহান্নামের মধ্যে ধৈর্যধারণ করা বা না করা সমান। তাদের কোন ওযর-আপত্তিও গ্রহণ করা হবে না এবং তাদের পাপও ক্ষমা করা হবে না। তাদের জন্যে দুনিয়ায় পুনরায় প্রত্যাবর্তনের পথও বন্ধ। এটা আল্লাহ তা'আলার নিম্নের উক্তির মতঃ
قَالُوْا رَبَّنَا غَلَبَتْ عَلَیْنَا شِقْوَتُنَا وَ كُنَّا قَوْمًا ضَآلِّیْنَ ـ رَبَّنَاۤ اَخْرِجْنَا مِنْهَا فَاِنْ عُدْنَا فَاِنَّا ظٰلِمُوْنَ ـ قَالَ اخْسَئُوْا فِیْهَا وَ لَا تُكَلِّمُوْنِ
অর্থাৎ “তারা বলবে- হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উপর আমাদের। দুর্ভাগ্য ছেয়ে গেছে, নিশ্চয়ই আমরা ছিলাম বিভ্রান্ত। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এর থেকে বের করে নিন, যদি আমরা পুনরায় এ কাজই করি তবে তো আমরা অবশ্যই যালিম হবো। আল্লাহ তা'আলা উত্তরে বলবেনঃ তোমরা এর মধ্যেই পড়ে থাকো এবং আমার সাথে কথা বলে না।”(২৩:১০৬-১০৮)