মুহাম্মদ আয়াত ২৩
اُولٰۤىِٕكَ الَّذِيْنَ لَعَنَهُمُ اللّٰهُ فَاَصَمَّهُمْ وَاَعْمٰٓى اَبْصَارَهُمْ ( محمد: ٢٣ )
Ulaaa'ikal lazeena la'anahumul laahu fa asammahum wa a'maaa absaarahum (Muḥammad ৪৭:২৩)
English Sahih:
Those [who do so] are the ones that Allah has cursed, so He deafened them and blinded their vision. (Muhammad [47] : 23)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
এদের প্রতিই আল্লাহ অভিসম্পাত করেন, অতঃপর তাদেরকে বধির করেন আর তাদের দৃষ্টিশক্তিকে করেন অন্ধ। (মুহাম্মদ [৪৭] : ২৩)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
ওরা তো তারা, যাদেরকে আল্লাহ অভিশপ্ত করে বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন করেন। [১]
[১] অর্থাৎ, এ ধরনের লোকদের কানগুলোকে মহান আল্লাহ (সত্য শোনা থেকে) বধির এবং চোখগুলোকে (সত্য দেখা হতে) অন্ধ করে দেন। আর এটা হল তাদের উল্লিখিত মন্দ কর্মসমূহের ফল।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
এরাই তারা, যাদেরকে আল্লাহ লা'নত করেছেন, ফলে তিনি তাদের বধির করেন এবং তাদের দৃষ্টিসমূহকে অন্ধ করেন।
3 Tafsir Bayaan Foundation
এরাই যাদেরকে আল্লাহ লানত করেছেন, ফলে তাদেরকে বধির ও তাদের দৃষ্টিসমূহকে অন্ধ করে দিয়েছেন।
4 Muhiuddin Khan
এদের প্রতিই আল্লাহ অভিসম্পাত করেন, অতঃপর তাদেরকে বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন করেন।
5 Zohurul Hoque
এরাই তারা যাদের প্রতি আল্লাহ্ ধিক্কার দিয়েছেন, ফলে তিনি তাদের বধির বানিয়েছেন এবং তাদের দৃষ্টি অন্ধ করে দিয়েছেন।
6 Mufti Taqi Usmani
এরাই তারা, যাদেরকে আল্লাহ লা’নত করেছেন (অর্থাৎ তাঁর রহমত থেকে দূর করে দিয়েছেন।) ফলে তাদেরকে বধির বানিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের চোখ অন্ধ করে দিয়েছেন।
7 Mujibur Rahman
আল্লাহ এদেরকেই করেন অভিশপ্ত, আর করেন বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন।
8 Tafsir Fathul Mazid
২০-২৩ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
মু’মিনরা জিহাদের প্রতি খুব আশা ব্যক্ত করে বলে : কেন এমন একটি সূরা অবতীর্ণ হয় না যাতে জিহাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু যখন মুহকাম সূরা তথা যার বিধান মানসুখ হয়নি বরং তাতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জিহাদ ফরয করে দেয়া হয়েছে এমন সূরা নাযিল হয় তখন তাদের মধ্যে যাদের অন্তরে দীনের ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে এবং মুনাফিকী রয়েছে তারা মুমূর্ষু ব্যক্তি মৃত্যুর সময় যেমন করে চোখ উলটিয়ে তাকায় তারাও জিহাদে না যাওয়ার বাহানা করে এমনভাবে তাকায়। অর্থাৎ তারা কাপুরুষ, জিহাদ করতে ভয় পায়, তাদের জন্য আফসোস।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
তুমি কি তাদেরকে দেখনি যাদেরকে বলা হয়েছিল, ‘তোমরা তোমাদের হস্ত সংবরণ কর, সালাত কায়েম কর এবং যাকাত দাও?’ অতঃপর যখন তাদেরকে যুদ্ধের বিধান দেয়া হল তখন তাদের একদল মানুষকে ভয় করছিল আল্লাহকে ভয় করার মত অথবা তদপেক্ষা অধিক, এবং বলতে লাগল, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য যুদ্ধের বিধান কেন দিলে? আমাদেরকে কিছু দিনের অবকাশ দাও না! বল : ‘পার্থিব ভোগ সামান্য এবং যে মুত্তাকী তার জন্য আখিরাতই উত্তম। তোমাদের প্রতি সামান্য পরিমাণও জুলুম করা হবে না।’ (সূরা নিসা ৪ : ৭৭)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন : ‘আল্লাহর প্রতি ঈমান আন এবং রাসূলের সঙ্গী হয়ে জিহাদ কর’- এ মর্মে যখন কোন সূরা অবতীর্ণ হয় তখন তাদের মধ্যে যাদের শক্তিসামর্থ্য আছে তারা তোমার নিকট অব্যাহতি চায় এবং বলে : ‘আমাদেরকে রেহাই দাও, যারা বসে থাকে আমরা তাদের সঙ্গেই থাকব।’
তারা স্ত্রীদের সঙ্গে অবস্থান করাই পছন্দ করেছে এবং তাদের অন্তরে মোহর মেরে দেয়া হয়েছে; ফলে তারা বুঝতে পারে না। (সূরা তাওবা ৯ : ৮৬-৮৭)
(الَّذِيْنَ فِيْ قُلُوْبِهِمْ مَّرَضٌ)
এরা হল মুনাফিক, যাদের কাছে জিহাদ বড় কষ্টকর মনে হত। কিছু কিছু দুর্বল মু’মিনরাও মাঝে মাঝে তাদের দলভুক্ত হয়ে যায়।
(فَأَوْلٰي لَهُمْ طَاعَةٌ وَّقَوْلٌ مَّعْرُوْفٌ)
‘তাদের জন্য উত্তম ছিল যে, আনুগত্য করবে এবং উত্তম কথা বলবে।’ অর্থাৎ জিহাদের নির্দেশ পেয়ে বিচলিত না হয়ে মু’মিনদের এটাই উচিত ছিল, টালবাহানামূলক কথা না বলে আনুগত্যমূলক কথা বলবে। কারণ কোন বিষয়ে নির্দেশ আসলে তা পালন করা কল্যাণকর।
(فَإِذَا عَزَمَ الْأَمْرُ)
‘কিন্তু যখন (জিহাদের) স্পষ্ট হুকুম এসে গেল’ তাদের আশা মতে যখন জিহাদ ফরয হয়ে গেল তখন তারা যদি আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য কামনা করত প্রচেষ্টা করে নির্দেশ বাস্তবায়ন করত তাহলে এটাই তাদের জন্য কল্যাণকর ছিল।
(فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ)
আভিধানিক দিক দিয়ে تولي শব্দের দুই অর্থ হয়ে থাকে- (১) মুখ ফিরিয়ে নেয়া, (২) কোন দলের ওপর শাসনক্ষমতা লাভ করা।
কেউ কেউ প্রথম অর্থ নিয়েছেন। যেমন আল্লামা সা‘দী (রহঃ) বলেন : সুতরাং দুটি বিষয়- হয় আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করবে, তাঁর নির্দেশ মেনে নেবে। তাহলে এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। অথবা আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য হতে মুখ ফিরিয়ে নেবে, ফলে অন্যায়-অবিচার ও খারাপ কাজ করে জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে। (তাফসীর সা‘দী)
আবার কেউ কেউ দ্বিতীয় অর্থ নিয়েছেন, যেমন ইমাম কুরতুবী (রহঃ) আয়াতের অর্থ হিসেবে বলেন, তোমাদের মনোবাঞ্ছনা পূর্ণ হলে অর্থাৎ দেশ ও জাতির শাসনক্ষমতা লাভ করলে এর ফলে এছাড়া কিছুই হবে না যে, তোমরা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে। (কুরতুবী) অতএব মুসলিমরা যখন আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের আনুগত্য থেকে বের হয়ে যাবে, জিহাদ বর্জন করবে তখন জমিনে ফাসাদ বেড়ে যাবে, অন্যায় কাজ স্বাভাবিক হয়ে যাবে, অনর্থক মানুষ মারা যাবে, নিহত ব্যক্তি নিজেও জানবে না কি জন্য তাকে হত্যা করা হয়েছে।
সুতরাং অত্র আয়াতে সাধারণভাবে পৃথিবীতে ফাসাদ ও অশান্তি সৃষ্টি এবং বিশেষভাবে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন না করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অধিকন্তু জমিনে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত মাখলুক সৃষ্টি করলেন। অতঃপর যখন সৃষ্টি থেকে অবসর হলেন, তখন আত্মীয়তা উঠে দাঁড়ালো এবং রহমানের (আল্লাহ তা‘আলার) কোমর ধরে নিলো (এবং ফরিয়াদ করল) আল্লাহ তা‘আলা বললেন : তুমি থাম। আত্মীয়তা আরজ করল : এ স্থান তার, যে আপনার সামনে আত্মীয়তার সম্পর্কচ্ছেদ হতে রেহাই প্রার্থনাকারী। আল্লাহ তা‘আলা বললেন : তুমি কি এতে সন্তুষ্ট না যে, যে ব্যক্তি তোমাকে বহাল ও সমুন্নত রাখবে তার সাথে আমিও সদাচরণ করব আর যে তোমাকে ছিন্ন করবে। আমি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করব। আত্মীয়তা আরজ করল : হ্যাঁ, আমি সন্তুষ্ট আছি। আল্লাহ তা‘আলা বললেন : তাহলে তোমার সাথে এ ওয়াদাই রইল। আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) বলেন : তোমরা ইচ্ছা করলে এ আয়াতটি পড়। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮৩২)
(أُولٰ۬ئِكَ الَّذِيْنَ لَعَنَهُمُ اللّٰهُ)
‘এরাই ঐসব লোক, যাদের ওপর আল্লাহ লা’নত করেছেন’ অর্থাৎ যারা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে তাদের ওপর লা’নত। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে বধির বানিয়ে দিয়েছেন, ফলে তাদের জন্য কল্যাণকর কোন বিষয় শুনতে পায় না এবং তাদেরকে অন্ধ বানিয়ে দিয়েছেন ফলে তারা কল্যাণকর জিনিস দেখতে পায় না।
অতএব, যে কোন উপায়ে ও যেকোন স্বার্থে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করা, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা একটি মারাত্মক অপরাধ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে যাবে না। (সহীহ বুখারী হা. ৫৯৮৪, সহীহ মুসলিম হা. ২৫৫৬)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. কল্যাণকর কাজের আকাক্সক্ষা করা জায়েয।
২. কাপুরুষতা ও আন্তরিক দুর্বলতাকে তিরস্কার করা হয়েছে।
৩. যারা জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করে তারা খারাপ জাতি।
৪. আল্লাহ তা‘আলার কোমর আছে, এর প্রমাণ পেলাম। কিন্তু কেমন তা জানি না।
৫. মুসলিমরা আল্লাহ তা‘আলার পথে জিহাদ বর্জন করলে পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি হবে এবং নিজেদের ওপর লাঞ্ছনা নেমে আসবে।
9 Fozlur Rahman
ওদেরকেই আল্লাহ অভিশপ্ত করেছেন, তারপর তাদেরকে বধির করেছেন ও তাদের চোখ অন্ধ করে দিয়েছেন।
10 Mokhtasar Bangla
২৩. এ সব কাজ তথা যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করা ও জ্ঞাতি-বন্ধন ছিন্ন করা ওদের কাজ যাদেরকে আল্লাহ তাঁর রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন, তাদের কানসমূহকে হকের কথা শ্রবণ থেকে বধির করেছেন এবং তাদের চোখগুলোকে উপদেশ গ্রহণমূলক দর্শন থেকে অন্ধ করে দিয়েছেন।
11 Tafsir Ibn Kathir
২০-২৩ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা'আলা মুমিনদের সম্বন্ধে খবর দিচ্ছেন যে, তারা তো জিহাদের হুকুমের আশা-আকাঙ্ক্ষা করে, কিন্তু যখন তিনি জিহাদ ফরয করে দেন ও ওর হুকুম জারী করে দেন তখন অধিকাংশ লোকই পিছনে সরে পড়ে। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ
اَلَمْ تَرَ اِلَى الَّذِیْنَ قِیْلَ لَهُمْ كُفُّوْۤا اَیْدِیَكُمْ وَ اَقِیْمُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتُوا الزَّكٰوةَ فَلَمَّا كُتِبَ عَلَیْهِمُ الْقِتَالُ اِذَا فَرِیْقٌ مِّنْهُمْ یَخْشَوْنَ النَّاسَ كَخَشْیَةِ اللّٰهِ اَوْ اَشَدَّ خَشْیَةً وَ قَالُوْا رَبَّنَا لِمَ كَتَبْتَ عَلَیْنَا الْقِتَالَ لَوْ لَاۤ اَخَّرْتَنَاۤ اِلٰۤى اَجَلٍ قَرِیْبٍ قُلْ مَتَاعُ الدُّنْیَا قَلِیْلٌ وَ الْاٰخِرَةُ خَیْرٌ لِّمَنِ اتَّقٰى وَ لَا تُظْلَمُوْنَ فَتِیْلًا
অর্থাৎ “তুমি কি তাদেরকে দেখোনি যাদেরকে বলা হয়েছিল- তোমরা তোমাদের হস্ত সংবরণ কর, নামায কায়েম কর এবং যাকাত দাও? অতঃপর যখন তাদেরকে যুদ্ধের বিধান দেয়া হলো তখন তাদের একদল মানুষকে ভয় করছিল আল্লাহকে ভয় করার মত অথবা তদপেক্ষা অধিক, এবং বলতে লাগলোঃ হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্যে যুদ্ধের বিধান কেন দিলেন? আমাদের কিছুদিনের জন্যে অবকাশ দেন না? বলঃ পার্থিব ভোগ সামান্য এবং যে আল্লাহভীরু তার জন্যে পরকালই উত্তম। তোমাদের প্রতি সামান্য পরিমাণও যুলুম করা হবে না।”(৪:৭৭)
মহামহিমান্বিত আল্লাহ এখানেও বলেনঃ মুমিনরা তো জিহাদের হুকুম সম্বলিত আয়াতগুলো অবতীর্ণ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করে, কিন্তু মুনাফিকরা যখন এই আয়াতগুলো শুনে তখন তারা মৃত্যুভয়ে বিহ্বল মানুষের মত তাকাতে থাকে। তাদের পরিণাম হবে অত্যন্ত শোচনীয়।
এরপর তাদেরকে যোদ্ধা ও বীরপুরুষ হবার উৎসাহ প্রদান করতে গিয়ে মহান আল্লাহ বলেনঃ তাদের জন্যে এটাই খুব ভাল হতো যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর কথা শুনতো, মানতো ও প্রয়োজনের সময় আন্তরিকতার সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হতো!
অতঃপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে সম্ভবতঃ তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। অর্থাৎ অজ্ঞতার যুগে তোমাদের যে অবস্থা ছিল ঐ অবস্থাই তোমাদের ফিরে আসবে। তাই আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ আল্লাহ এদেরকেই করেন অভিশপ্ত, আর করেন বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন। এর দ্বারা ভূ-পৃষ্ঠে বিপর্যয় সৃষ্টি ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করতে বিশেষভাবে নিষেধ করা হয়েছে এবং ভূ-পৃষ্ঠে শান্তি স্থাপন করার ও আত্মীয়তার সম্পর্ক যুক্ত রাখার হিদায়াত করেছেন। আত্মীয়তার সম্পর্ক যুক্ত রাখার অর্থ হলো আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করা এবং তাদের আর্থিক সংকটের সময় তাদের উপকার করা। এ ব্যাপারে বহু সহীহ ও হাসান হাদীস বর্ণিত আছে।
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা'আলা তাঁর সমস্ত মাখলুক সৃষ্টি করলেন, অতঃপর যখন তা হতে ফারেগ হলেন তখন আত্মীয়তা উঠে দাঁড়ালো এবং রহমানের (আল্লাহ তা'আলার) কোমর ধরে নিলো (অর্থাৎ আবদারের সুরে ফরিয়াদ করলো)। তখন আল্লাহ বললেনঃ “থামো, কি চাও, বল?” আত্মীয়তা আরয করলোঃ “এই স্থান তার, যে আপনার কাছে আত্মীয়তার সম্পর্কচ্ছেদ হতে রেহাই প্রার্থনাকারী (অর্থাৎ আমি আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আপনারই মাধ্যমে সেই কাজ হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, কেউ আমার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে এবং আত্মীয়তার পবিত্রতা বহাল রাখবে না)। আল্লাহ তা'আলা বললেনঃ “তুমি কি এই কথায় সম্মত আছ যে, যে ব্যক্তি তোমাকে বহাল এবং সমুন্নত রাখবে তার সাথে আমিও সদাচরণ করবো। আর যে তোমাকে ছিন্ন করবে, আমি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবো?” আত্মীয়তা আরয করলোঃ “হ্যা, আমি সম্মত আছি।” আল্লাহ বললেনঃ “তাহলে তোমার সাথে আমার এ ওয়াদাই রইলো। এ হাদীসটি বর্ণনা করার পর হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেনঃ “তোমরা যদি চাও তবে فَهَلْ عَسَيْتُمْ اِنْ تَوَلَّيْتُمْ ـ ـ ـ -এ আয়াতটি পাঠ কর।" (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। সহীহ মুসলিমেও এটা বর্ণিত আছে) অন্য সনদে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বয়ং বলেছিলেনঃ “তোমরা ইচ্ছা করলে فَهَلْ عَسَیْتُمْ اِنْ تَوَلَّیْتُمْ اَنْ تُفْسِدُوْا فِی الْاَرْضِ وَ تُقَطِّعُوْۤا اَرْحَامَكُمْ -এ আয়াতটি পাঠ কর।”
হযরত আবূ বাকরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কোন পাপই এতোটা যোগ্য নয় যে, পাপীকে আল্লাহ তা'আলা খুব শীঘ্র এই দুনিয়াতেই প্রতিফল দিবেন এবং আখিরাতে তার জন্যে শাস্তি জমা করে রাখবেন। তবে হ্যা, এরূপ দু'টি পাপ রয়েছেঃ (এক) সমসাময়িক নেতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা এবং (দুই) আত্মীয়তার বন্ধনকে ছিন্ন করা।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম আবু দাউদ (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) ও ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত সাওবান (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে চায় যে, তার মৃত্যু বিলম্বে হোক এবং জীবিকায় প্রাচুর্য হোক সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক যুক্ত রাখে। (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে)
হযরত আমর ইবনে শুআয়েব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি তাঁর পিতা হতে এবং তিনি তাঁর দাদা হতে বর্ণনা করেছেন যে, একটি লোক রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট এসে বলেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমার কতক আত্মীয়-স্বজন রয়েছে, আমি তাদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক যুক্ত রাখি কিন্তু তারা আমার সাথে তা ছিন্ন করে, আমি তাদের (অপরাধ) ক্ষমা করি কিন্তু তারা আমার প্রতি যুলুম করে, আমি তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করি কিন্তু তারা আমার সাথে দুর্ব্যবহার করে, এমতাবস্থায় আমি কি তাদের হতে প্রতিশোধ গ্রহণ করবো?" তিনি জবাবে বললেনঃ “না, এরূপ করলে তোমাদের সকলকেই ছেড়ে দেয়া হবে। তুমি বরং তাদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক যুক্ত রাখবে। আর জেনে রেখো যে, তুমি যতদিন এরূপ করতে থাকবে ততদিন আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে সদা-সর্বদা তোমার সাথে সহায়তাকারী থাকবে।" (এ হাদীসটিও ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আত্মীয়তা আল্লাহ তাআলার আরশের সাথে ঝুলন্ত ৩ আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী নয় যার সাথে তা রক্ষা করা হয়েছে (অর্থাৎ এতে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার বিনিময়ে শুধু তা রক্ষা করা হয়েছে)। বরং আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী হলো ঐ ব্যক্তি, যার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়েছে, আর সে সেই সম্পর্ককে যোজনা করে আত্মীয়তার বন্ধন বহাল রেখেছে।" (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন আত্মীয়তাকে রাখা হবে এমন অবস্থায় যে, ওর হরিণের উরুর মত উরু হবে। ওটা হবে অত্যন্ত পরিষ্কার ও তীক্ষ্ণ বাকশক্তি সম্পন্ন। সুতরাং যে ওকে ছিন্ন করেছে তাকেও ছিন্ন করা (অর্থাৎ আল্লাহর রহমত তার থেকে ছিন্ন করা) হবে এবং যে ওকে যুক্ত রেখেছে তার সাথে আল্লাহর রহমত যুক্ত রাখা হবে।” (এ হাদীসটিও মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহর নবী (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি অনুগ্রহকারীদের প্রতি রহমান (আল্লাহ) অনুগ্রহ বর্ষণ করেন। সুতরাং তোমরা যমীনের অধিবাসীদের প্রতি অনুগ্রহ কর, তাহলে আকাশের মালিক তোমাদের উপর অনুগ্রহ বর্ষণ করবেন। রাহেম' (আত্মীয়তা) শব্দটি (আল্লাহ তা'আলার গুণবাচক) নাম রহমান’ হতে নির্গত। যে ব্যক্তি ওকে যোজনা করে আল্লাহ তার সাথে নিজের রহমত যোজনা করেন, আর যে ওকে ছিন্ন করে তিনি তার হতে নিজের সম্পর্ক ছিন্ন করেন।” (এ হাদীসটিও ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। জামে তিরমিযীতেও এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান সহীহ বলেছেন)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ফারিয (রাঃ) হতে বর্ণিত, তাঁর পিতা তার কাছে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ)-এর রোগাক্রান্ত অবস্থায় তার নিকট গমন করেন। তখন হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ) তাকে বলেন, আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক যুক্ত করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন যে, মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “আমি আল্লাহ, আমি রহমান। আমি রাহেম (আত্মীয়তাকে) সৃষ্টি করেছি এবং রাহেম নামটি আমি আমার রহমান নাম হতে নির্গত করেছি। সুতরাং যে ব্যক্তি আত্মীয়তাকে যোজিত করবে (অর্থাৎ আত্মীয়তার সম্পর্ক বহাল রাখবে) আমি তাকে আমার রহমতের সাথে যোজিত করবো। আর যে ব্যক্তি আত্মীয়তাকে ছিন্ন করবে, আমিও তাকে আমার রহমত হতে বিচ্ছিন্ন করবো।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম আবু দাউদ (রঃ) ও ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এ ব্যাপারে আরো বহু হাদীস রয়েছে)
হযরত সুলাইমান (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “রূহসমূহ শরীরে প্রবেশ করার পূর্বে অর্থাৎ আদিকালে একদল পতাকাধারী সৈন্যের মত ছিল। অতঃপর রূহসমূহকে শরীরের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে বিক্ষিপ্ত করা হয়েছে। সুতরাং যেই রূহসমূহ শরীরে প্রবেশ করানোর পূর্বে পরস্পরের পরিচিত ছিল এখনো তারা পরস্পরের পরিচিত এবং একে অপরের সাথে বন্ধুরে বন্ধনে আবদ্ধ। আর যেই রূহসমূহ ঐ সময় পরস্পর অপরিচিত ছিল তারা এখনো পরস্পরে মতানৈক্য।”
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যখন মুখের দাবী বৃদ্ধি পাবে ও আমল কমে যাবে, মৌখিক মিল থাকবে ও অন্তরে শত্রুতা থাকবে এবং আত্মীয়-স্বজনের সাথে দুর্ব্যবহার করা হবে তখন এরূপ লোকের উপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হবে এবং তাদের কর্ণ বধির ও চক্ষু অন্ধ করে দেয়া হবে। এ সম্পর্কে আরো বহু হাদীস রয়েছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।