আল হাদীদ আয়াত ১১
مَنْ ذَا الَّذِيْ يُقْرِضُ اللّٰهَ قَرْضًا حَسَنًا فَيُضٰعِفَهٗ لَهٗ وَلَهٗٓ اَجْرٌ كَرِيْمٌ ( الحديد: ١١ )
man zal lazee yuqridul laaha qardan hasanan fa yudaa'ifahoo lahoo wa lahooo ajrun kareem (al-Ḥadīd ৫৭:১১)
English Sahih:
Who is it that would loan Allah a goodly loan so He will multiply it for him and he will have a noble reward? (Al-Hadid [57] : 11)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
এমন কে আছে যে, আল্লাহকে উত্তম ঋণ দিবে? তাহলে তিনি তা তার জন্য কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিবেন আর তার জন্য আছে সম্মানজনক প্রতিফল। (আল হাদীদ [৫৭] : ১১)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
কে আছে যে আল্লাহকে দেবে উত্তম ঋণ? তাহলে তিনি তা বহুগুণে তার জন্য বৃদ্ধি করবেন এবং তার জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার। [১]
[১] আল্লাহকে উত্তম ঋণ দেওয়ার অর্থ তাঁর পথে দান-খয়রাত করা। এই মাল যা মানুষ আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তা আল্লাহরই দেওয়া। তা সত্ত্বেও সেটাকে ঋণ বলে আখ্যায়িত করা আল্লাহর একান্ত অনুগ্রহ বৈ কিছু নয়। তিনি এর প্রতিদান অবশ্যই দেবেন, যেমন ঋণ পরিশোধ করা অত্যাবশ্যক হয়।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
এমন কে আছে যে আল্লাহকে দেবে উত্তম ঋণ? তাহলে তিনি বহু গুণ এটাকে বৃদ্ধি করবেন তার জন্য। আর তার জন্য রয়েছে সম্মানজনক পুরুস্কার [১]।
[১] এটা আল্লাহ তা'আলার চরম উদারতা ও দানশীলতা যে, মানুষ যদি তাঁরই দেয়া সম্পদ তাঁর পথে ব্যয় করে তাহলে তিনি তা নিজের জন্য ঋণ হিসেবে গ্ৰহণ করেন। অবশ্য শর্ত এই যে, তা “কর্জে হাসানা” (উত্তম ঋণ) হতে হবে। অর্থাৎ খাঁটি নিয়তে কোন ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য ছাড়াই তা দিতে হবে, তার মধ্যে কোন প্রকার প্রদর্শনীর মনোবৃত্তি, খ্যাতি ও নাম-ধামের আকাংখা থাকবে না, তা দিয়ে কাউকে খোঁটা দেয়া যাবে না, দাতা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই দেবে এবং এছাড়া অন্য কারো প্রতিদান বা সস্তুষ্টি লক্ষ্য হবে না। এ ধরনের ঋণের জন্য আল্লাহর দুইটি প্রতিশ্রুতি আছে। একটি হচ্ছে, তিনি তা কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে ফেরত দেবেন। অপরটি হচ্ছে, এজন্য তিনি নিজের পক্ষ থেকে সর্বোত্তম পুরস্কারও দান করবেন। সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে অনেকেই এটাকে বাস্তবে রুপান্তরিত করেছিলেন। [কুরতুবী; ফাতহুল কাদীরা]
3 Tafsir Bayaan Foundation
এমন কে আছে যে, আল্লাহকে উত্তম করয দিবে ? তাহলে তিনি তার জন্য তা বহুগুণে বৃদ্ধি করে দিবেন এবং তার জন্য রয়েছে সম্মানজনক প্রতিদান।
4 Muhiuddin Khan
কে সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহকে উত্তম ধার দিবে, এরপর তিনি তার জন্যে তা বহুগুণে বৃদ্ধি করবেন এবং তার জন্যে রয়েছে সম্মানিত পুরস্কার।
5 Zohurul Hoque
কে সেইজন যে আল্লাহ্কে কর্জ দেয় উত্তম কর্জ, ফলে তিনি এটিকে তারজন্য বহুগুণিত করে দেন, আর তার জন্য রয়েছে সম্মানিত পুরস্কার?
6 Mufti Taqi Usmani
কে আছে, যে আল্লাহকে ঋণ দেবে, উত্তম ঋণ? তাহলে তিনি দাতার জন্য তা বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেবেন এবং তার জন্য রয়েছে মহা প্রতিদান।
7 Mujibur Rahman
কে আছে যে আল্লাহকে দিবে উত্তম ঋণ? তাহলে তিনি বহু গুণে একে বৃদ্ধি করবেন এবং তার জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার।
8 Tafsir Fathul Mazid
৭-১১ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে ঈমান আনার পাশাপাশি তাদেরকে যে সম্পদের উত্তরাধিকারী বানিয়েছেন তা থেকে ব্যয় করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। এ কথা ইঙ্গিত প্রদান করছে, তোমাদের নিকটে যে ধন-সম্পদ আছে তা চিরদিন তোমাদের কাছে থাকবে না। তোমরা যেমন উত্তরাধিকারী সূত্রে পেয়েছো তোমরা মারা গেলে পরবর্তীরা উত্তরাধিকারী সূত্রে মালিক হয়ে যাবে। অতএব তোমরা আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় না করলে তারা ব্যয় করে অশেষ নেকী হাসিল করে নেবে। হাদীসে এসেছে : মানুষ বলে আমার সম্পদ আমার সম্পদ। অথচ তোমার সম্পদ হল প্রথমত সেটা যা খেয়ে শেষ করে ফেলেছো। দ্বিতীয়ত : যা পরিধান করে নষ্ট করে ফেলেছো। তৃতীয়ত : যা তুমি আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করে আখিরাতের জন্য সঞ্চয় করেছো। এছাড়া যা কিছু থাকবে তা সবই অন্যদের ভাগে আসবে। (সহীহ মুসলিম হা. ২৯৫৯, তিরমিযী হা. ২৩৪৯) সুতরাং যে আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সম্পদ দান করেছেন, যে পথে ব্যয় করলে তিনি খুশি হবেন সে পথেই ব্যয় করা উচিত। তাঁর অবাধ্য ও পাপ কাজে ব্যয় করা উচিত হবে না।
(وَمَا لَکُمْ لَا تُؤْمِنُوْنَ بِاللہِ)
এখানে মহান আল্লাহ তাদের তিরস্কার করছেন যাদের কাছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দাওয়াত পৌঁছেছে কিন্তু তারপরে ঈমান আনছে না। তিরস্কার করে আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : তোমাদের কী আপত্তি ও কী বাধা রয়েছে যে- তোমরা ঈমান আনছ না, অথচ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তোমাদেরকে ঈমানের দিকে আহ্বান করছেন!
(وَقَدْ أَخَذَ مِيْثَاقَكُمْ)
আল্লামা ইবনু কাসীর (রহঃ) أَخَذَ ক্রিয়ার কর্তা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বুঝিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদের নিকট থেকে বাইয়াত গ্রহণ করেছেন যে, সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় তাঁর কথা শুনবে ও মানবে। ইবনু জারীর (রহঃ) এ ক্রিয়ার কর্তা আল্লাহ তা‘আলাকে বুঝিয়েছেন। অর্থ হল : সেই অঙ্গীকার যা মহান আল্লাহ রূহ জগতে আদম (আঃ)-এর পৃষ্ঠদেশ থেকে বের করে সকল মানুষের কাছ থেকে নিয়েছিলেন। যেমন সূরা আ‘রাফের ১৭২ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন যে- তোমরা ঈমান আনবে; অধিকন্তু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও সে ঈমানের দিকে আহ্বান করছেন তারপরেও ঈমান আনছ না।
(لَا يَسْتَوِيْ مِنْكُمْ مَّنْ أَنْفَقَ مِنْ قَبْلِ الْفَتْحِ وَقَاتَلَ)
‘তোমাদের মধ্যে যারা (মক্কা) বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে ও সংগ্রাম করেছে, উভয়ে সমান নয়’ এখানে الْفَتْحِ বা বিজয় দ্বারা কোন্ বিজয়কে বুঝোনো হয়েছে তা নিয়ে দুটি মত পাওয়া যায়।
(১) বিজয় দ্বারা উদ্দেশ্য হল হুদায়বিয়ার সন্ধি। (সহীহ বুখারী হা. ৪১৫০)
(২) বিজয় দ্বারা উদ্দেশ্য হল মক্কা বিজয়। এটা অধিকাংশ আলেমদের অভিমত। (ইবনু কাসীর, শরহু আকিদাহ ওয়াসিতিয়াহ)
অর্থাৎ যারা হুদায়বিয়ার সন্ধি বা মক্কা বিজয়ের পূর্বে আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করেছেন ও জিহাদ করেছেন তারা অধিক নেকী ও মর্যাদাসম্পন্ন তাদের থেকে যারা হুদায়বিয়ার সন্ধি বা মক্কা বিজয়ের পর আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করেছেন ও জিহাদ করেছেন। কেননা হুদায়বিয়ার সন্ধি বা মক্কা বিজয়ের পূর্বের ব্যয় ও জিহাদ উভয়টাই ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
(وَكُلًّا وَّعَدَ اللّٰهُ الْحُسْنٰي)
অর্থাৎ সাহাবীদের মধ্যে মর্যাদার তারতম্য থাকা সত্ত্বেও সকলের জন্য রয়েছে কল্যণের প্রতিশ্রুতি তথা জান্নাত। তাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বিশ্বাস হল : মর্যাদাগত তারতম্য থাকা সত্ত্বেও সকল সাহাবীদের ব্যাপারে আমাদের অন্তর সকল প্রকার হিংসা বিদ্বেষ মুক্ত এবং জবান সকল প্রকার অকথ্য ও অশালীন কথা থেকে মুক্ত। যেমন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : তোমরা আমার সাহাবীদেরকে গালি দিয়ো না। সে সত্ত্বার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, তোমাদের কেউ যদি উহুদ পরিমাণ স্বর্ণ আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করে তবুও তাদের এক মুদ বা অর্ধ মুদ (প্রায় ৬২৫ গ্রাম) এর সমান হবে না। (সহীহ বুখারী হা. ৩৬৭৩, সহীহ মুসলিম হা. ২৫৪১)।
(مَنْ ذَا الَّذِیْ یُقْرِضُ اللہَ)
আল্লাহ তা‘আলাকে উত্তম ঋণ দেওয়ার অর্থ হল তাঁর পথে ব্যয় করা। যারা আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করবে তিনি তাদের প্রতিদান বহুগুণে বাড়িয়ে দেবেন এবং উত্তম প্রতিদান দেবেন। তবে অবশ্যই তা হতে হবে হালাল ও উত্তম সম্পদ হতে, সুস্থ-সবল ও সম্পদের প্রতি মোহ থাকাবস্থায় এবং আল্লাহ তা‘আলাকে সস্তুষ্ট করার জন্য; কাউকে খুশি করা বা বাহবা পাওয়ার জন্য নয়।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. সম্পদকে নেয়ামত মনে করে তার সৎব্যবহার করা উচিত।
২. ঈমানের সাথে নেকীর আশায় দান করলে আল্লাহ তা‘আলা মহা পুরস্কার প্রদান করবেন।
৩. সাহাবীদের মর্যাদা জানতে পেলাম।
৪. সাহাবীদের ব্যাপারে কুটক্তি করা, হিংসা বিদ্বেষ পোষণ করা সে যে কোন সাহাবীর ব্যাপারে হোক না কেন তা হারাম।
৫. আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় ব্যয় করার ফযীলত জানতে পারলাম।
৬. সমস্ত সম্পদের প্রকৃত মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, মানুষকে তা ব্যবহার করার অধিকার দিয়েছেন।
৭. আমলের তারতম্য অনুপাতে জান্নাতে মর্যাদার তারতম্য হবে।
9 Fozlur Rahman
এমন কে আছে, যে আল্লাহকে একটা ভাল ঋণ দিতে পারে? তার জন্য তিনি তা বহুগুণ বাড়িয়ে দেবেন। উপরন্তু, তার জন্য রয়েছে এক সম্মানজনক পুরস্কার (জান্নাত)।
10 Mokhtasar Bangla
১১. কে এমন আছে যে নিজ সম্পদকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে খুশী মনে ব্যয় করবে, ফলে আল্লাহ তার ব্যয়িত সম্পদের বহু গুণ বেশী প্রতিদান দিবেন। আর তার জন্য থাকবে কিয়ামত দিবসে সম্মানজনক প্রতিদান তথা জান্নাত?!
11 Tafsir Ibn Kathir
৭-১১ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা নিজের উপর এবং নিজের রাসূল (সঃ)-এর উপর ঈমান আনয়ন ও ওর উপর দৃঢ়তা ও স্থায়িত্বের সাথে প্রতিষ্ঠিত থাকার হিদায়াত করছেন এবং তাঁর পথে খরচ করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করছেন। তিনি বলেনঃ আল্লাহ তা'আলা তোমাদেরকে যে মাল হস্তান্তর রূপে দিয়েছেন, তোমরা তার আনুগত্য হিসেবে তা ব্যয় কর এবং বুঝে নাও যে, এই মাল যেমন অন্যের হাত হতে তোমার হাতে এসেছে, তেমনিভাবে তোমার হাত হতে সত্বরই এটা অন্যের হাতে চলে যাবে। আর তোমার জন্যে রয়ে যাবে হিসাব ও শাস্তি। এতে এ ইঙ্গিতও রয়েছে যে, হয়তো তোমার উত্তরাধিকারী সৎ হবে এবং তোমার সম্পদকে আমার পথে খরচ করে আমার নৈকট্য লাভ করবে, আবার এ সম্ভাবনাও রয়েছে যে, সে অসৎ হবে এবং মন্দ কাজে ও অন্যায় পথে তোমার সম্পদ উড়িয়ে দিবে এবং এই অন্যায় কাজের উৎস তুমিই হবে। কারণ তুমি যদি এ সম্পদ ছেড়ে না যেতে তবে তোমার ওয়ারিস এটা অন্যায় কাজে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগে পেতো না।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে শাখীর (রাঃ) তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ (সঃ) আল্লাহ তাআলার উক্তির উদ্ধৃতি দেনঃ اَلْهٰكُمُ التَّكَاثُرُ অর্থাৎ “প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে।” (১০২:১) অতঃপর তিনি বলেনঃ “ইবনে আদম বলেঃ আমার মাল, আমার মাল। অথচ তার মাল তো ওটাই যা সে খেয়েছে, পরেছে এবং দান খায়রাত করেছে। যা সে খেয়েছে তা নিঃশেষ হয়েছে, যা সে পরিধান করেছে তা পুরনো হয়ে গেছে, আর যা সে আল্লাহর পথে দান করেছে তা তার কাছে সঞ্চিত রয়েছে। আর যা সে ছেড়ে গেল তা অন্যদের মাল। সে তা লোকদের জন্যে ছেড়ে গেল।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। সহীহ মুসলিমেও এটা বর্ণিত হয়েছে এবং এতে শেষের অংশটুকু অতিরিক্ত রয়েছে)
এ দু’টি কাজের প্রতি আল্লাহ তা'আলা উৎসাহ প্রদান করছেন এবং খুব বড় পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “তোমাদের কি হলো যে, তোমরা আল্লাহতে ঈমান আন না? অথচ রাসূল (সঃ) তোমাদেরকে তোমাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আনতে আহ্বান করছে। তিনি মানুষের নিকট দলীল-প্রমাণাদি উপস্থাপন করেছেন এবং তাদেরকে মু'জিযা প্রদর্শন করছেন। সহীহ বুখারীর শরাহর প্রাথমিক অংশ কিতাবুল ঈমানে আমরা এ হাদীসটি বর্ণনা করে এসেছি যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর সাহাবীদেরকে (রাঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ “তোমাদের নিকট উত্তম ঈমানদার ব্যক্তি কে?” উত্তরে তাঁরা বলেনঃ “ফেরেশতাগণ ।” তিনি বলেনঃ “তারা তো আল্লাহ তা'আলার নিকট রয়েছে, সুতরাং তারা ঈমানদার হয়েছে এতে বিস্ময়ের কি আছে?” তখন তারা বললেনঃ “তাহলে নবীগণ।” তিনি বলেনঃ “তাঁদের উপর তো অহী ও আল্লাহর কালাম অবতীর্ণ হয়, সুতরাং তারা তো ঈমান আনবেনই।” তারা তখন বলেনঃ “তাহলে আমরা।” তিনি বলেনঃ “কেন তোমরা ঈমানদার হবে না? আমি তো তোমাদের মধ্যে জীবিত অবস্থায় বিদ্যমান রয়েছি। জেনে রেখো যে, উত্তম বিস্ময়পূর্ণ ঈমানদার হলো ঐ লোকেরা যারা তোমাদের পরে আসবে। তারা সহীফা ও গ্রন্থসমূহে সবকিছুই লিপিবদ্ধ দেখে ঈমান আনয়ন করবে।”
সূরায়ে বাকারার শুরুতে اَلَّذِيْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِالْغَيْبِ (২:৩) এর তাফসীরেও আমরা এরূপ হাদীসগুলো লিপিবদ্ধ করেছি।
এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা মানুষকে তাদের কৃত অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেনঃ আল্লাহ তোমাদের নিকট হতে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন। যেমন তিনি বলেনঃ
وَ اذْكُرُوْا نِعْمَةَ اللّٰهِ عَلَیْكُمْ وَ مِیْثَاقَهُ الَّذِیْ وَاثَقَكُمْ بِهٖۤ اِذْ قُلْتُمْ سَمِعْنَا وَ اَطَعْنَا
অর্থাৎ “তোমরা আল্লাহর ঐ নিয়ামতের কথা স্মরণ কর যা তোমাদের উপর রয়েছে এবং স্মরণ কর তার সাথে কৃত ঐ অঙ্গীকারকে যা তিনি তোমাদের নিকট হতে গ্রহণ করেছেন, যখন তোমরা বলেছিলেঃ আমরা শুনলাম ও মানলাম।” (৫:৭)
এর দ্বারা আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর হাতে বায়আত গ্রহণ করা বুঝানো হয়েছে। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, এই মীসাক’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ঐ মীসাক বা অঙ্গীকার যা হযরত আদম (আঃ)-এর পৃষ্ঠে তাদের নিকট হতে গ্রহণ করা হয়েছিল। হযরত মুজাহিদ (রঃ)-এরও এটাই মাযহাব। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
মহান আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহই তাঁর বান্দার প্রতি (হযরত মুহাম্মাদ সঃ-এর প্রতি) সুস্পষ্ট ও উজ্জ্বল আয়াতসমূহ অবতীর্ণ করেছেন, যাতে তিনি তোমাদেরকে যুলুম, অবিচার ও অন্যায়ের অন্ধকার হতে বের করে সুস্পষ্ট ও উজ্জ্বল হিদায়াত ও সত্যের পথে আনয়ন করতে পারেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি করুণাময়, পরম দয়ালু।
এটা আল্লাহ তা'আলার বড় মেহেরবানী যে, তিনি স্বীয় বান্দাদেরকে সুপথ প্রদর্শনের জন্যে কিতাব ও রাসূল পাঠিয়েছেন, সংশয়-সন্দেহ দূর করেছেন এবং হিদায়াত সুস্পষ্ট করেছেন।
আল্লাহ পাক ঈমান আনয়ন ও দান-খয়রাতের হুকুম করে, তারপর ঈমানের প্রতি উৎসাহিত করে এবং এটা বর্ণনা দিয়ে যে, ঈমান না আনার এখন কোন ওরের সুযোগে নেই, দান-খয়রাতের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেন এবং বলেনঃ আমার পথে খরচ করতে থাকো এবং দারিদ্রকে ভয় করো না। কারণ যার পথে তোমরা খরচ করছো তিনি যমীন ও আসমানের ধন-ভাণ্ডারের একাই মালিক। আরশ ও কুরসী তাঁরই এবং তিনি তোমাদের কাছে তোমাদের এ দান-খয়রাতের প্রতিদান দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন। যেমন তিনি বলেছেনঃ
وَ مَاۤ اَنْفَقْتُمْ مِّنْ شَیْءٍ فَهُوَ یُخْلِفُهٗ وَ هُوَ خَیْرُ الرّٰزِقِیْنَ
অর্থাৎ “তোমরা (আল্লাহর পথে) যা কিছু খরচ করেছে, তিনি তোমাদেরকে ওর উত্তম প্রতিদান প্রদান করবেন এবং তিনি উত্তম রিযকদাতা।” (৩৪:৩৯) আর এক জায়গায় বলেনঃ
مَا عِنْدَكُمْ یَنْفَدُ وَ مَا عِنْدَ اللّٰهِ بَاقٍ
অর্থাৎ “তোমাদের কাছে যা রয়েছে তা শেষ হয়ে যাবে এবং আল্লাহর কাছে যা রয়েছে তা চিরস্থায়ী (তা কখনো শেষ হবার নয়)।” (১৬:৯৬)
যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে খরচ করতে থাকে এবং আরশের মালিক হতে কমে যাওয়ার ভয় করে না, সত্বরই তিনি তাকে উত্তম বিনিময় প্রদান করবেন। তারা নির্ভরশীল যে, আল্লাহর পথে যা খরচ করছে তার প্রতিদান তারা ইহকালে ও পরকালে অবশ্যই পাবে।
এরপর মহান আল্লাহ বলছেন যে, মক্কা বিজয়ের পূর্বে যারা ধন-সম্পদ খরচ করেছে এবং যারা তা করেনি, তারা কখনো সমান নয়, যদিও তারা মক্কা বিজয়ের পর খরচ করে থাকে। কারণ মক্কা বিজয়ের পূর্বে মুসলমানদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয় এবং শক্তি ছিল খুবই কম। আর এজন্যেও যে, ঐ সময় ঈমান শুধু ঐ লোকেরাই কবুল করতো যাদের অন্তর সম্পূর্ণরূপে কালিমামুক্ত ছিল। মক্কা বিজয়ের পর মুসলমানদের শক্তি বহুগুণ বৃদ্ধি পায়, সংখ্যাও বেড়ে যায় এবং বহু অঞ্চল বিজিত হয়। এর সাথে সাথে মুসলমানদের আর্থিক অবস্থাও ভাল হয়। সুতরাং ঐ সময় ও এই সময়ের মধ্যে যেই পার্থক্য, ঐ সময়ের মুসলমান ও এই সময়ের মুসলমানদের মধ্যেও সেই পার্থক্য। ঐ সময়ের মুসলমানরা বড় রকমের প্রতিদান প্রাপ্ত হবে, যদিও উভয় যুগের মুসলমানরাই প্রকৃত কল্যাণ লাভে অংশীদার।
কেউ কেউ বলেন যে, এখানে বিজয় দ্বারা হুদায়বিয়ার সন্ধিকে বুঝানো হয়েছে। মুসনাদে আহমাদের নিম্নের রিওয়াইয়াতটি এর পৃষ্ঠপোষকতা করেঃ
হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালীদ (রাঃ) এবং হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ)-এর মধ্যে কিছু মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। হযরত খালিদ (রাঃ) হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ)-কে বলেনঃ “আপনি আমার কিছু দিন পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছেন বলেই আমার উপর গর্ব প্রকাশ করছেন!” রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কানে এ খবর পৌঁছলে তিনি বলেনঃ “আমার সাহাবীদেরকে (রাঃ) আমার জন্যে ছেড়ে দাও। যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! যদি তোমরা উহুদ বা অন্য কোন পাহাড়ের সমান সোনা খরচ কর তবুও তাদের আমলের সমপর্যায়ে পৌঁছতে পারবে না।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন।)
প্রকাশ থাকে যে, এটা হযরত খালিদ (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের পরের ঘটনা এবং তিনি হুদায়বিয়ার সন্ধির পরে এবং মক্কা বিজয়ের পূর্বে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। আর যে মতানৈক্যের বর্ণনা এই হাদীসে রয়েছে তা বানু জুযাইমা গোত্রের ব্যাপারে ঘটেছিল। রাসূলুল্লাহ (সঃ) মক্কা বিজয়ের পর হযরত খালিদ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে একদল সৈন্য এই গোত্রের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। যখন তারা সেখানে পৌঁছেন তখন ঐ লোকগুলো বলতে শুরু করেঃ “আমরা মুসলমান হয়েছি। কিন্তু অজানার কারণে আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি’ একথা না বলে ‘আমরা সা’বী বা বেদ্বীন হয়েছি' একথা বলেন। কেননা, কাফিররা মুসলমানদেরকে একথাই বলতো। হযরত খালিদ (রাঃ) এই কালিমার ভাবার্থ - বুঝতে না পেরে তাদেরকে হত্যা করার নির্দেশ দেন। এমন কি তাদের যারা বন্দী হয় তাদেরকেও হত্যা করার আদেশ করেন। এই ঘটনায় হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ) এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) হযরত খালিদ (রাঃ)-এর বিরধিতা করেন। এই ঘটনাটির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা উপরে বর্ণিত হাদীসে রয়েছে।
সহীহ হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার সাহাবীদেরকে (রাঃ) মন্দ বলো না। যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তার শপথ! তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড়ের সমানও সোনা (আল্লাহর পথে) খরচ করে তবুও তাদের তিন পাই শস্যের পুণ্যেও পৌঁছতে পারবে না। এমন কি দেড় পাই পুণ্যেও পৌছতে সক্ষম হবে না।”
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হুদায়বিয়ার সন্ধির বছর যখন আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে গাসফান নামক স্থানে পৌঁছি তখন তিনি বলেনঃ “এমন লোকও আসবে যাদের আমলের তুলনায় তোমরা তোমাদের আমলকে নগণ্য মনে করবে।” সাহাবীগণ প্রশ্ন করেনঃ “তারা কি কুরায়েশ হবে?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “না, বরং ইয়ামনী। তাদের অন্তর হবে কোমল এবং চরিত্র হবে অত্যন্ত মধুর।” আমরা বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! তারা কি আমাদের চেয়ে উত্তম হবে? উত্তর দিলেন তিনিঃ “তাদের কারো কাছে যদি উহুদ পাহাড়ের সমানও সোনা থাকে এবং সে তা আল্লাহর পথে খরচও করে ফেলে তবুও তোমাদের কারো তিন পাই, এমনকি দেড় পাই শস্য দান করার পুণ্যও সে লাভ করতে পারবে না। জেনে রেখো যে, আমাদের মধ্যে এবং সারা দুনিয়ার লোকদের মধ্যে এটাই পার্থক্য।” অতঃপর তিনি لَا يَسْتَوِىْ مِنْكُمْ ـ ـ ـ আয়াতটি তিলাওয়াত করেন।”
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর রিওয়াইয়াতে খারেজীদের সম্পর্কে রয়েছেঃ “তোমরা তাদের নামায ও রোযার তুলনায় তোমাদের নামায ও রোযাকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে। তারা দুনিয়া হতে এমনিভাবে বের হয়ে যাবে যেমনিভাবে তীর কামান হতে বের হয়।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) ও ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এ রিওয়াইয়াতটি গারীব বা দুর্বল)
ইমাম ইবনে জারীর (রঃ)-এর রিওয়াইয়াতে রয়েছেঃ “সত্বরই এমন এক কওমের আবির্ভাব হবে যে, যখন তোমরা তাদের আমলের সঙ্গে তোমাদের আমলের তুলনা করবে তখন তোমাদেরকে খুবই কম মনে করবে।” সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! তারা কি কুরায়েশ হবে?” জবাবে তিনি বলেনঃ “না, তারা হবে সরল চিত্ত ও কোমল হৃদয়ের লোক এবং ওখানকার অধিবাসী।” অতঃপর তিনি ইয়ামনের দিকে স্বীয় হস্ত মুবারক দ্বারা ইশারা করেন। তারপর বলেনঃ “তারা হবে ইয়ামনী লোক। ইয়ামনবাসীদের ঈমানই তো প্রকৃত ঈমান এবং ইয়ামনবাসীদের হিকমতই তো প্রকৃত হিকমত।” সাহাবীগণ (রাঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ “তারা কি আমাদের চেয়েও উত্তম হবে?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “যার হাতে আমার জীবন রয়েছে তাঁর শপথ! যদি তাদের মধ্যে কারো নিকট সোনার পাহাড়ও থাকে এবং ওটাকে সে আল্লাহর পথে দানও করে ফেলে তবুও সে তোমাদের এক মুদ বা অর্ধ মুদ এরও পর্যায়ে পৌঁছতে পারবে না।” অতঃপর তিনি তার অঙ্গুলিগুলো বন্ধ করেন এবং কনিষ্ঠাঙ্গুলি বাড়িয়ে দিয়ে বলেনঃ “জেনে রেখো যে, এটাই পার্থক্য হলো আমাদের মধ্যে ও তাদের মধ্যে।” অতঃপর তিনি لَا يَسْتَوِىْ مِنْكُمْ ـ ـ ـ -এ আয়াতটি তিলাওয়াত করেন।
এ হাদীসে হুদায়বিয়ার উল্লেখ নেই। সুতরাং এও হতে পারে যে, মক্কা বিজয়ের পূর্বেই আল্লাহ তা'আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে ওটা বিজয়ের পরবর্তী খবর দিয়েছিলেন। যেমন মক্কা শরীফে অবতীর্ণ প্রাথমিক সূরাগুলোর অন্যতম সূরা, সূরায়ে মুযযামমিলে রয়েছেঃ
وَ اٰخَرُوْنَ یُقَاتِلُوْنَ فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ
অর্থাৎ “কেউ কেউ আল্লাহর পথে সংগ্রামে লিপ্ত হবে।” (৭৩:২০) সুতরাং যেমন এই আয়াতে আগামীতে সংঘটিতব্য একটি ঘটনার বর্ণনা রয়েছে, তেমনই এই আয়াত এবং হাদীসকেও বুঝে নিতে হবে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ তবে আল্লাহ উভয়ের কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অর্থাৎ মক্কা বিজয়ের পূর্বে এবং পরেও যে কেউ যা কিছু আল্লাহ তা'আলার পথে ব্যয় করেছে তার প্রতিদান তিনি তাকে অবশ্যই প্রদান করবেন। কাউকেও বেশী দেয়া হবে এবং কাউকেও কম দেয়া হবে। সেটা স্বতন্ত্র কথা। যেমন আল্লাহ তা'আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ
لَا یَسْتَوِی الْقٰعِدُوْنَ مِنَ الْمُؤْمِنِیْنَ غَیْرُ اُولِی الضَّرَرِ وَ الْمُجٰهِدُوْنَ فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ بِاَمْوَالِهِمْ وَ اَنْفُسِهِمْ فَضَّلَ اللّٰهُ الْمُجٰهِدِیْنَ بِاَمْوَالِهِمْ وَ اَنْفُسِهِمْ عَلَى الْقٰعِدِیْنَ دَرَجَةً وَ كُلًّا وَّعَدَ اللّٰهُ الْحُسْنٰى وَ فَضَّلَ اللّٰهُ الْمُجٰهِدِیْنَ عَلَى الْقٰعِدِیْنَ اَجْرًا عَظِیْمًا
অর্থাৎ “মুমিনদের মধ্যে যারা অক্ষম নয় অথচ ঘরে বসে থাকে ও যারা আল্লাহর পথে স্বীয় ধন-প্রাণ দ্বারা জিহাদ করে তারা সমান নয়। যারা স্বীয় ধন-প্রাণ দ্বারা জিহাদ করে আল্লাহ তাদেরকে যারা ঘরে বসে থাকে তাদের উপর মর্যাদা দিয়েছেন। আল্লাহ সবকেই কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যারা ঘরে বসে। থাকে তাদের উপর যারা জিহাদ করে তাদেরকে আল্লাহ মহা পুরস্কারের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন।” (৪:৯৫)
অনুরূপভাবে সহীহ হাদীসেও রয়েছেঃ “সবল মুমিন ভাল ও আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় দুর্বল মুমিন হতে, তবে কল্যাণ উভয়ের মধ্যে রয়েছে।”
যদি এই আয়াতের এই বাক্যটি না থাকতো তবে সম্ভবতঃ মানুষ এই পরবর্তীদেরকে তুচ্ছ মনে করতো। এ জন্যেই পূর্ববর্তীদের ফযীলত বর্ণনা করার পর সংযোগ স্থাপন করে মূল প্রতিদানে উভয়কে শরীক করা হয়েছে।
মহান আল্লাহ এরপর বলেনঃ তোমরা যা কর আল্লাহ তা সবিশেষ অবহিত। তিনি মর্যাদায় যে পার্থক্য রেখেছেন তা অনুমানে নয়, বরং সঠিক জ্ঞান দ্বারা। হাদীসে এসেছেঃ “এক দিরহাম এক লক্ষ দিরহাম হতে বেড়ে যায়। এটাও স্মরণ রাখার বিষয় যে, এই আয়াতের বড় অংশের অংশীদার হলেন হযরত আবু বকর (রাঃ)। কেননা, এর উপর আমলকারী সমস্ত নবীর উম্মতবর্গের ইনি নেতা। তিনি প্রাথমিক সংকীর্ণতার সময় নিজের সমুদয় মাল আল্লাহর পথে দান করে দিয়েছিলেন। এর প্রতিদান তিনি আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে চাননি।
হযরত উমার (রাঃ) বলেনঃ “আমি একদা দরবারে নববীতে (সঃ) বসেছিলাম। হযরত আবু বকর (রাঃ) ছিলেন। তাঁর গায়ে একটি মাত্র পোশাক ছিল যার খোলা অংশ তিনি কাঁটা দ্বারা আটকিয়ে রেখেছিলেন। এমন সময় হযরত জিবরাঈল (আঃ) এসে পড়েন এবং জিজ্ঞেস করেনঃ “ব্যাপার কি? হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর গায়ে একটি মাত্র পোশাক, তাও আবার কাঁটা দিয়ে আটকানো রয়েছে, কারণ কি?" উত্তরে নবী (সঃ) বললেনঃ “সে তার সমুদয় সম্পদ আমার কাজে মক্কা বিজয়ের পূর্বেই আল্লাহর পথে খরচ করে ফেলেছে। এখন তার কাছে আর কিছুই নেই। একথা শুনে হযরত জিবরাঈল (আঃ) নবী (সঃ)-কে বললেনঃ “তাকে বলুন যে, আল্লাহ তাআলা তাকে সালাম দিয়েছেন এবং বলেছেন যে, তিনি তাঁর দারিদ্র অবস্থায় আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট না অসন্তুষ্ট?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর নিকট এ ঘটনা বর্ণনা করেন এবং তাঁর কাছে জবাব চান। তিনি তখন আরয করেনঃ “আমি আমার মহামহিমান্বিত প্রতিপালকের উপর কি করে অসন্তুষ্ট হতে পারি? আমি আমার প্রতিপালকের উপর সন্তুষ্ট।” (এ হাদীসটি আবু মুহাম্মাদ হুসাইন ইবনে মাসউদ বাগাভী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। সনদের দিক দিয়ে এ হাদসটি দুর্বল। এসব ব্যাপারে আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন)
অতঃপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেনঃ “কে আছে যে আল্লাহকে দিবে উত্তম ঋণ?' এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্যে খরচ করা। কেউ কেউ বলেন যে, উদ্দেশ্য হলো ছেলে-মেয়েদেরকে খাওয়ানো, পরানো ইত্যাদিতে খরচ। হতে পারে যে, এ আয়াতটি উমূম বা সাধারণত্বের দিক দিয়ে দুটো উদ্দেশ্যকেই অন্তর্ভুক্ত করে।
এরপর আল্লাহ পাক বলেন যে, (যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান করবে) তার জন্যে তিনি ওটাকে বহুগুণে বৃদ্ধি করবেন। যেমন আল্লাহ তা'আলা অন্য আয়াতে বলেনঃ اَضْعَافًا كَثِيْرَةً وَّلَهٗ اَجْرٌ كَرِيْمٌ অর্থাৎ “ওটাকে তিনি বহুগুণে বদ্ধি করবেন এবং তার জন্যে রয়েছে মহা পুরস্কার। অর্থাৎ উত্তম পুরস্কার ও পবিত্র রিযক এবং ওটা হলো কিয়ামতের দিনে জান্নাত।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন مَنْ ذَا الَّذِيْ يُقْرِضُ اللّٰهَ ـ ـ ـ-এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় তখন আবুদ দাহদাহ আনসারী (রাঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আল্লাহ তা'আলা কি আমাদের কাছে ঋণ চাচ্ছেন?" উত্তরে রাসূলুল্লাহ বলেনঃ “হ্যাঁ, হে আবু দাহদাহ!" তখন হযরত আবুদ দাহদাহ (রাঃ) বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনার হাতটি আমাকে দেখান (আপনার হাতটি আমার দিকে বাড়িয়ে দিন)।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তার হস্ত মুবারক বাড়িয়ে দিলেন। হযরত আবু দাহদাহ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হাতটি নিজের মধ্যে নিয়ে বললেনঃ “আমি আমার ঐ বাগানটি আল্লাহ তা'আলাকে ঋণ স্বরূপ দিলাম যাতে ছয়শটি খেজুরের গাছ রয়েছে। তার স্ত্রী এবং ছেলে-মেয়েও ঐ বাগানে ছিলেন। তিনি আসলেন এবং বাগানের দরবার উপর দাঁড়িয়ে তাঁর স্ত্রীকে ডাক দিলেন। স্ত্রী তার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে আসলেন। তখন তিনি স্ত্রীকে বললেন, তুমি (ছেলে-মেয়ে নিয়ে) বেরিয়ে এসো। আমি আমার মহামহিমান্বিত প্রতিপালককে এ বাগানটি ঋণ স্বরূপ দিয়ে দিয়েছি।” স্ত্রী খুশী হয়ে বললেনঃ “আপনি খুবই লাভজনক ব্যবসায় হাত দিয়েছেন।” অতঃপর ছেলে-মেয়ে ও ঘরের আসবাবপত্র নিয়ে বেরিয়ে আসলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “জান্নাতী গাছ ও তথাকার বাগান যা ফলে পরিপূর্ণ এবং যার শাখাগুলো ইয়াকূত ও মণিমুক্তার তা আল্লাহ তা'আলা আবুদ দাহদাহ (রাঃ)-কে দান করলেন।”