১৫১-১৫৩ নং আয়াতের তাফসীর:
আলোচ্য তিনটি আয়াত কুরআনুল কারীমের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আয়াত। আয়াতগুলোতে ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি হারাম বিধানের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে-
( وَأَنَّ هٰذَا صِرَاطِيْ مُسْتَقِيْمًا فَاتَّبِعُوْهُ)
অর্থাৎ এ বিধানই হচ্ছে আমার সরল পথ, সুতরাং তোমরা এ পথেরই অনুসরণ কর। তাই ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন: যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর শেষ অসীয়তের প্রতি লক্ষ করতে চায় সে যেন উল্লিখিত আয়াতগুলো তেলাওয়াত করে। (হাকিম ২য় খণ্ড, পৃঃ ৩৭৭, সহীহ)
ইবনু মাউসদ (রাঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলার চেয়ে অধিক আত্মমর্যাদাশীল আর কেউ নেই। তাই তিনি প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল খারাপ কাজ হারাম করেছেন। প্রশংসা করার চেয়ে আল্লাহ তা‘আলার কাছে অধিক প্রিয় বস্তু আর কিছুই নেই। তাই তিনি নিজের প্রশংসা নিজেই করেছেন। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৩৪, সহীহ মুসলিম হা: ২৭৬০)
আয়াতগুলোর সূচনা করা হয়েছে এভাবে যে,
(قُلْ تَعَالَوْا أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ)
অর্থাৎ যারা আল্লাহ তা‘আলার দেয়া হালালকে হালাল ও হারামকে হারাম হিসেবে মেনে নিয়েছ অথবা নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে যা ইচ্ছা হালাল ও হারাম করে নিয়েছ সবাই এসো তোমাদেরকে পাঠ করে শুনাই যা আল্লাহ তা‘আলা হারাম করে দিয়েছেন। আয়াতে সকল মানবজাতি শামিল।
সর্বপ্রথম মহাপাপ যা হারাম করা হয়েছে তা হল:
(أَلَّا تُشْرِكُوْا بِه۪ شَيْئًا)
‘আল্লাহ তা‘আলার সাথে কোন কিছু শরীক করো না।’সকল ইবাদত একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্যই সম্পাদন করবে। মক্কার মুশরিকদের মত আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করতে কাউকে ওসীলা বানাবে না, ইয়াহূদী খ্রিস্টানদের মত নাবীদেরকে আল্লাহ তা‘আলার পুত্র বানাবে না। অন্যদের মত ফেরেশতাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার কন্যা মনে করবে না। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার রুবুবিয়্যাহ, উলুহিয়্যাহ ও আসমায়ি ওয়াস সিফাত সকল ক্ষেত্রে তাঁর তাওহীদ বহাল রাখবে। কেননা শির্ক সবচেয়ে বড় জুলুম। আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
اَكْبَرُ الْكَبَائِرِ الثَّلَاثَةُ مِنْهَا اَلْاِشْرَاكُ بِاللّٰهِ
কবীরা গুনাহর মধ্যে সবচেয়ে বড় তিনটি তার মধ্যে প্রধান হল আল্লাহ তা‘আলার সাথে শরীক করা।
আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতে দিবেন। কিন্তু তিনি শির্কের গুনাহ ক্ষমা করবেন না।
দু’টি অপরাধ রয়েছে যা দুনিয়াতেও ক্ষতি করে, আখিরাতেও ক্ষতি করে।
প্রথম: শির্ক, যা মানুষের অতীত আমলকে বরবাদ করে জাহান্নামে নিয়ে যায় এবং আল্লাহ তা‘আলাকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়।
দ্বিতীয়: বিদআত, যা করলে মানুষের সে আমল কবূল হয় না এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়।
দ্বিতীয়ত যে মহাপাপ হারাম করা হয়েছে তা হল: পিতা-মাতার সাথে অসদাচরণ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَّبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا)
‘পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে’অর্থাৎ কথায়, কাজে ও আচরণে পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করা ওয়াজিব। অসদাচরণ করা হারাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَقَضٰي رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوْآ إِلَّآ إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا)
“তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ব্যতীত অন্য কারও ‘ইবাদত কর না ও পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর।”(সূরা ইসরা ১৭:২৩)
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করলেন: সর্বোত্তম কাজ কোন্টি? তিনি বললেন: যথাসময়ে সালাত আদায় করা। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন: এরপর কোন্টি? তিনি বললেন: পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করা। প্রশ্ন করলেন: তারপর কোন্টি? তিনি বললেন: আল্লাহ তা‘আলার পথে জিহাদ করা। (সহীহ বুখারী হা: ৫২৭)
এমনকি পিতা-মাতা মুশরিক হলেও সদাচরণ করতে হবে। কিন্তু শরীয়ত বিরোধী কোন কাজ করতে বললে তা করা যাবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَإِنْ جَاهَدٰكَ عَلٰٓي أَنْ تُشْرِكَ بِيْ مَا لَيْسَ لَكَ بِه۪ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوْفًا)
“আর যদি তোমার পিতা-মাতা তোমাকে চাপ দেয় যে, তুমি আমার সাথে এমন কিছু শির্ক কর, যে সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তখন তুমি তাদের কথা মানবে না কিন্তু দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস কর।” (সূরা লুকমান ৩১:১৫)
পিতা-মাতার সাথে সদাচরণের ব্যাপারে অনেক আয়াত ও সহীহ হাদীস রয়েছে। মোটকথা পিতা-মাতার প্রতি সদারচণ এমন ফরয যা পালন করলে সহজে জান্নাতে যাওয়া যায়, আবার তাদের সাথে অসদারচণ এমন হারাম কর্ম যা সহজে জাহান্নামে নিয়ে যায়।
লক্ষণীয় যে, কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলা যেখানেই নিজের অধিকারের কথা বলেছেন সেখানেই পিতা-মাতার অধিকারের কথা বলেছেন। এতেই অনুধাবন করা যায় যে, পিতা-মাতার সাথে সদাচরণের গুরুত্ব কতটুকু।
তৃতীয় হারাম:
(وَلَا تَقْتُلُوْآ أَوْلَادَكُمْ مِّنْ إِمْلَاقٍ)
‘দারিদ্রের ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না’অর্থাৎ খাদ্য ঘাটতির ভয়ে সন্তান হত্যা করা হারাম।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قَدْ خَسِرَ الَّذِيْنَ قَتَلُوْآ أَوْلَادَهُمْ سَفَهًام بِغَيْرِ عِلْمٍ)
“যারা নির্বুদ্ধিতার দরুন ও অজ্ঞতাবশত নিজেদের সন্তানদেরকে হত্যা করে তারা ক্ষতিগ্রস্ত।”(সূরা আন্‘আম ৬:১৪০)
ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! কোন অপরাধ সবচেয়ে বড়? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: তুমি আল্লাহ তা‘আলার সাথে অংশী স্থাপন করলে অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমি বললাম, তারপর কোন্টি? তিনি বললেন: তোমার সাথে খাবে এ ভয়ে সন্তান হত্যা করলে। অতঃপর আমি বললাম: তারপর কোন্টি? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: তোমার প্রতিবেশির সাথে ব্যভিচার করলে। তারপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন:
(وَالَّذِيْنَ لَا يَدْعُوْنَ مَعَ اللّٰهِ إِلَهًا آخَر... )
(সহীহ বুখারী হা: ৬০০১)
এখানে সন্তান হত্যা বলতে সন্তান না নেয়ার সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা। অধিক সন্তান না নেয়া। পরিবার বড় হলে সন্তানদের খাদ্য, বাসস্থান ও খরচাদি ইত্যাদি বহন করা কষ্টকর হবে। এসব কারণে সন্তান না গ্রহণ করা হারাম। রিযিকের মালিক আল্লাহ, দুনিয়াতে এমন কোন প্রাণী পাঠান না যার রিযিকের দায়িত্ব তিনি নেন না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَي اللّٰهِ رِزْقُهَا)
“পৃথিবীতে যত প্রাণী রয়েছে, সব কিছুর রিযিকের দায়িত্ব আল্লাহর কাছে।”(সূরা হুদ ১১:৬)
তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে ও খাদ্যসহ ভরণপোষণের ভয়ে সন্তান হত্যা তথা বিনা কারণে সন্তান না নেয়া হারাম। তবে যদি মায়ের ও সন্তানের স্বাস্থের দিকে বিবেচনা করে প্রয়োজনে কিছু বিলম্ব করা হয় তাহলে তা দূষণীয় নয়।
চতুর্থ হারাম হল:
(وَلَا تَقْرَبُوا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ)
‘প্রকাশ্যে হোক কিংবা গোপনে হোক অশ্লীল কাজের নিকটেও যাবে না।’খারাপ কাজ হল: প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য যে সকল কাজ করা আল্লাহ তা‘আলা অপছন্দ করেন এবং সে কাজে লিপ্ত হবার জন্য জাহান্নাম বা কঠিন শাস্তির কথা বলেছেন। অর্থাৎ সকল কবীরা গুনাহ এর অন্তর্ভুক্ত।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّـيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَنْ تُشْرِكُوْا بِاللّٰهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِه۪ سُلْطٰنًا وَّأَنْ تَقُوْلُوْا عَلَي اللّٰهِ مَا لَا تَعْلَمُوْنَ)
“বল: নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক হারাম করেছেন প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা, আর পাপ ও অন্যায় বিরোধিতা এবং কোন কিছুকে আল্লাহর সাথে শরীক করা যার কোন প্রমাণ তিনি প্রেরণ করেননি, এবং আল্লাহ সম্বন্ধে এমন কিছু বলা যা তোমরা জান না।(সূরা আ‘রাফ ৭:৩৩)
পঞ্চম হারাম হল, অন্যায়ভাবে হত্যা করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِيْ حَرَّمَ اللّٰهُ إِلَّا بِالْحَقِّ)
‘আল্লাহ যাকে হত্যা করা হারাম করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতীরেকে তোমরা তাকে হত্যা করবে না।’অর্থাৎ অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা হারাম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তিনটির কোন একটি কারণ ছাড়া কোন মুসলিম ব্যক্তিকে হত্যা করা হারাম।
১. বিবাহিত ব্যভিচারী, তাকে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করা হবে।
২. কিসাস হিসেবে প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ।
৩. যে ব্যক্তি ইসলাম থেকে বের হয়ে আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে অর্থাৎ মুরতাদ। (আবূ দাঊদ ৪৩৫৩, নাসাঈ হা: ৪০৫৯, সহীহ)
এছাড়াও বুখারী ও মুসলিমে এ ব্যাপারে অসংখ্য হাদীস রয়েছে।
এ আয়াতটিতে পাচঁটি হারাম বিষয়ের বর্ণনা দেয়ার পর বলা হয়েছে: ‘তোমাদেরকে তিনি এ নির্দেশ দিলেন যেন তোমরা অনুধাবন কর।’
ষষ্ঠ হারাম হল ইয়াতীমের সম্পদ অবৈধভাবে ভক্ষণ করা:
(وَلَا تَقْرَبُوْا مَالَ الْيَتِيْمِ)
‘ইয়াতীম বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত উত্তম পন্থা ব্যতীত তোমরা তার সম্পত্তির নিকটবর্তী হবে না।’সকলের সম্পদ অন্যায়ভাবে খাওয়া হারাম। বিশেষ করে ইয়াতীমের সম্পদ আরও হারাম। এ সম্পর্কে সূরা নিসা-এর শুরুতে আলোচনা হয়েছে।
সপ্তম হারাম ওজনে ও মাপে করা: আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَأَوْفُوا الْكَيْلَ وَالْمِيْزَانَ بِالْقِسْطِ)
‘এবং পরিমাণ ও ওজন ন্যায্যভাবে পুরোপুরি দেবে।’অর্থাৎ ওজনে ও পরিমাণে ন্যায়ভাবে পুরোপুরি প্রদান করা কর্তব্য। ওজনে ও পরিমাণে কম দেয়া হারাম, বেশি নেয়াও হারাম।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَيْلٌ لِّلْمُطَفِّفِيْنَ - الَّذِيْنَ إِذَا اكْتَالُوْا عَلَي النَّاسِ يَسْتَوْفُوْنَ - وَإِذَا كَالُوْهُمْ أَوْ وَّزَنُوْهُمْ يُخْسِرُوْنَ)
“মন্দ পরিণাম তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়, যারা লোকের নিকট হতে নেয়ার সময় পূর্ণ মাত্রায় গ্রহণ করে, এবং যখন তাদের জন্য মেপে অথবা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়।”(সূরা মুতাফফিফীন ৮৩:১-৩)
ওজনে ও পরিমাণে কম দেয়া শুয়াইব (আঃ)-এর জাতির বৈশিষ্ট্য ছিল। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন।
অষ্টম নির্দেশ: ন্যায় ও সুবিচারের বিপরীত কাজ করা হারাম: আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
(وَإِذَا قُلْتُمْ فَاعْدِلُوْا وَلَوْ كَانَ ذَا قُرْبٰي)
‘যখন তোমরা কথা বলবে তখন ন্যায্য বলবে, স্বজনের সম্পর্কে হলেও’এখানে বিশেষ কোন কথার উল্লেখ করা হয়নি। তাই সকল কথা এতে শামিল, তা কোন সাক্ষ্যের ব্যাপারে হোক, কোন বিচার ফায়সালার ক্ষেত্রে হোক, কিংবা কোন লেনদেনের ব্যাপারে হোক। আল্লাহ তা‘আলা সকল ক্ষেত্রে এমনকি নিজের আত্মীয়-স্বজনের ক্ষেত্রে ন্যায় সাক্ষ্য আর সত্য কথা বলার নির্দেশ দিচ্ছেন। সুতরাং স্বজন-প্রীতি করা, পক্ষপাতিত্ব করা ও অন্যায়ভাবে কারো পক্ষে ফায়সালা দেয়া সম্পূর্ণ হারাম।
নবম নির্দেশ: আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করা: বলা হয়েছে-
(وَبِعَهْدِ اللّٰهِ أَوْفُوْا)
‘এবং আল্লাহকে প্রদত্ত অঙ্গীকার পূর্ণ করবে’এ অঙ্গীকার বলতে হতে পারে সে অঙ্গীকার যা রূহ জগতে প্রত্যেক আত্মা থেকে আল্লাহ তা‘আলা নিয়েছিলেন যে,
(أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ)
আমি কি তোমাদের রব নই? তখন সবাই বলেছিল: بَلَي شَهِدْنَا হ্যাঁ, অবশ্যই আপনি আমাদের রব। এ অঙ্গীকারের দাবী হল যে, পালনকর্তা হিসেবে আল্লাহ তা‘আলাকে মানতে হবে এবং সকল ইবাদত তাঁর জন্যই সম্পাদন করতে হবে।
অথবা আল্লাহ তা‘আলা ও বান্দার মাঝে এবং মানুষের পরস্পর সকল প্রকার অঙ্গীকার হতে পারে, যেমন সূরা মায়িদাহ’র শুরুতে তুলে ধরা হয়েছে।
দশম নির্দেশ:
(وَأَنَّ هٰذَا صِرَاطِيْ مُسْتَقِيْمًا فَاتَّبِعُوْهُ)
‘আর নিশ্চয়ই এ পথই আমার সহজ-সরল পথ। সুতরাং তোমরা এরই অনুসরণ করবে’এ সঠিক পথ বলতে ইসলামকে বুঝানো হয়েছে। এ পথেরই অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ তা‘আলা। এ পথ ছাড়া অন্য কোন পথের অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। অন্যপথে চললে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে। এসব বিধি-বিধান আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করে দিয়েছেন যেন মানুষ মুত্তাকী হতে পারে।
একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর হাত দিয়ে একটি লম্বা রেখা টানলেন এবং বললেন, এটা হল আল্লাহ তা‘আলার সরল পথ। আরো কিছু রেখা তার ডান ও বাম পাশে টানলেন এবং বললেন, এগুলো হল অন্য কিছু পথ যার ওপর শয়তান বসে আছে এবং সে এ পথগুলোর দিকে মানুষকে আহ্বান করে। তারপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এ
(وَأَنَّ هٰذَا صِرَاطِيْ مُسْتَقِيْمًا)
আয়াত তিলাওয়াত করলেন। (মুসনাদ আহমাদ হা: ৪১৪২, সহীহ) এ সিরাতে মুসতাকীম হল, মুসলিম উম্মাহর মূল ভিত্তি। এ সরল পথ থেকে দূরে সরে পড়ার কারণে উম্মত বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।
অতএব সেই সরল পথে ফিরে আসতে হলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নির্দেশ মত সকল পথ ও মত বর্জন করে কুরআন ও সহীহ হাদীসের মাধ্যমে ইসলাম মেনে চলতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللَّهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ
আমি তোমাদের মাঝে দু’টি বিষয় রেখে যাচ্ছি, যতদিন তা আঁকড়ে ধরে থাকবে ততদিন পথভ্রষ্ট হবে না। সে দু’টি বিষয় হল আল্লাহ তা‘আলার কিতাব কুরআন ও তাঁর নাবীর সুন্নাত হাদীস। (মুয়াত্তা মালিক হা: ৩৩৩৮)
অতএব উপরোক্ত হারাম বিষয়গুলো হতে বেঁচে থেকে কুরআন ও সহীহ হাদীস অনুযায়ী সিরাতে মুসতাকীমে প্রতিষ্ঠিত থাকা প্রতিটি মু’মিন-মুসলিমের একান্ত কর্তব্য।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. গুরুত্বপূর্ণ দশটি হারাম বিধান জানতে পারলাম।
২. পিতা-মাতার অধিকারের গুরুত্ব জানতে পারলাম।
৩. আল্লাহ তা‘আলা কারো সাধ্যাতীত বিধান প্রদান করেন না।
৪. নাজাত কেবল কুরআন ও সহীহ হাদীসের পথেই রয়েছে, অন্য কোন পথে নয়।