৪৫-৪৬ নং আয়াতের তাফসীর:
এখানে আল্লাহ তা'আলা স্বীয় মুমিন বান্দাদেরকে যুদ্ধের কৌশল এবং শত্রুদের সাথে মুকাবিলার সময় বীরত্ব প্রকাশ করার কথা শিক্ষা দিচ্ছেন। এক যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সঃ) সূর্য পশ্চিম গগণে ঢলে পড়ার পর দাঁড়িয়ে গিয়ে বলেনঃ “হে লোকসকল! যুদ্ধে শত্রুদের সম্মুখীন হওয়ার আশা করো না। আল্লাহর নিকট নিরাপত্তার প্রার্থনা কর। কিন্তু যখন শত্রুদের সাথে মুকাবিলা হয়ে যাবে তখন যুদ্ধক্ষেত্রে অটল থাকো এবং বিশ্বাস রাখো যে, জান্নাত তরবারীর ছায়ার নীচে রয়েছে। তারপর তিনি দাঁড়িয়ে গিয়ে আল্লাহ তা'আলার নিকট প্রার্থনা করেনঃ “হে কিতাব অবতীর্ণকারী আল্লাহ! হে মেঘমালাকে চালনাকারী আল্লাহ! হে সেনাবাহিনীকে পরাজিতকারী আল্লাহ! এই কাফিরদেরকে পরাজিত করুন এবং তাদের উপর আমাদেরকে সাহায্য করুন। (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) আবদুল্লাহ ইবনে আবি আউফা (রাঃ) হতে মারফুরূপে তাখরীজ করেছেন)
আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা শত্রুদের সাথে মুকাবিলা করার আকাঙ্ক্ষা করো না এবং আল্লাহর নিকট নিরাপত্তার প্রার্থনা করো। আর তাদের সাথে মুকাবিলার সময় স্থির পদে থাকো ও বীরত্ব প্রদর্শন করো এবং আল্লাহকে স্মরণ করো। তারা যদিও হৈ হুল্লোড় ও চিৎকার করে তবে তোমরা নীরবতা অবলম্বন করো।”
তিবরানীর (রঃ) হাদীস গ্রন্থে যায়েদ ইবনে আরকাম (রঃ) হতে বর্ণিত আছে। যে, “রাসূল(সঃ) বলেছেন, তিন সময় আল্লাহ তা'আলা নীরবতা পছন্দ করেন(১) কুরআন কারীম পাঠের সময়, (২) যুদ্ধের সময় এবং (৩) জানাযার সময়।” অন্য একটি মারফু হাদীসে রয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “আমার কামেল বান্দা হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যে শত্রুর সাথে মুকাবিলার সময়েও আমার যিক্র করে অর্থাৎ ঐ অবস্থাতেও আমার যি করতে, আমার কাছে প্রার্থনা জানাতে এবং আমার নিকট ফরিয়াদ করতে অমনোযোগী হয় না।" কাতাদা (রঃ) বলেন যে, পূর্ণ ব্যস্ততার সময়েও অর্থাৎ যখন তরবারী চলতে থাকে তখনও আল্লাহ তা'আলা তাঁর যির ফরয করেছেন। আতা (রঃ)-এর উক্তি রয়েছে যে, যুদ্ধের সময়েও নীরবতা অবলম্বন করা এবং আল্লাহ তা'আলার যিক্র করা ওয়াজিব। অতঃপর তিনি এই আয়াতটি পাঠ করেন। তখন জুরাইজ (রঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করেনঃ “আল্লাহ তা'আলার যি কি উচ্চ শব্দে করতে হবে? তিনি উত্তরে বলেনঃ “হ্যা।" কা'ব ইবনে আহবার (রঃ) বলেনঃ “কুরআন কারীমের তিলাওয়াত এবং আল্লাহ তা'আলার যিক্র হতে বেশী প্রিয় আল্লাহ পাকের নিকট আর কিছুই নেই। এর মধ্যে আবার ওটাই উত্তম যার হুকুম মানুষকে সালাতের মধ্যে ও জিহাদে দেয়া হয়েছে। তোমরা কি দেখছো না যে, আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা জিহাদের সময়েও তাঁর যিক্র করার হুকুম করেছেন?” তারপর তিনি এই আয়াতটিই পাঠ করেন। কোন কবি বলেনঃ “ঠিক যুদ্ধ ও লড়াইয়ের সময়েও আমার অন্তরে আপনার (আল্লাহর) স্মরণ হয়ে থাকে।” আনতারা বলেনঃ “বর্শা ও তরবারীর কাজ চালু থাকা অবস্থাতেও আমি আপনাকে (আল্লাহকে) স্মরণ করতে থাকি। সুতরাং এই আয়াতে মহান আল্লাহ শত্রুদের সাথে মুকাবিলার সময় যুদ্ধক্ষেত্রে অটল থাকার ও ধৈর্যধারণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তারা (মুমিনরা) যেন ভীরুতা প্রদর্শন না করে এবং ভয় না পায়। আল্লাহর উপরই যেন ভরসা করে এবং তারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। তারা যেন সর্বদা আল্লাহকেই স্মরণ করে, কখনও যেন তাকে ভুলে না যায়। এটাই হচ্ছে সফলতার উপায় । আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর আনুগত্য পরিত্যাগ না করে। তারা যা বলেন তা-ই যেন পালন করে এবং যা করতে নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাকে। পরস্পর যেন ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত না হয় এবং মতানৈক্য সৃষ্টি না করে। নতুবা তারা লাঞ্ছিত হয়ে যাবে, তাদেরকে কাপুরুষতায় ঘিরে ফেলবে এবং তারা শক্তিহীন হয়ে পড়বে। এর ফলে তাদের অগ্রযাত্রায় বাধা পড়বে। তারা ধৈর্যের অঞ্চল যেন ছেড়ে না দেয় এবং তারা যেন বিশ্বাস রাখে ধৈর্যশীলদের সাথে স্বয়ং আল্লাহ রয়েছেন। সাহাবায়ে কিরাম এই হুকুম এমন পুরোপুরিভাবে পালন করেছিলেন যে, তাদের তুলনা পূর্বেও ছিল না এবং পরবর্তীদের মধ্যে তো তুলনার কোন কথাই উঠতে পারে না। এই বীরত্ব, এই রাসূল (সঃ)-এর প্রতি আনুগত্য এবং এই ধৈর্য ও সহ্যই ছিল আল্লাহ তা'আলার সাহায্য লাভের কারণ। আর এর ফলেই অতি অল্প সময়ের মধ্যে সংখ্যার স্বল্পতা এবং যুদ্ধাস্ত্রের নগণ্যতা সত্ত্বেও মুসলিমরা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দেশগুলো জয় করে নেন। তারা শুধুমাত্র বিজিত দেশগুলোর অধিপতিই হননি। বরং অধিবাসীদের অন্তরও জয় করে ফেলেন এবং তাদেরকে আল্লাহর পথে নিয়ে আসেন। রোমক, পারসিক, তুর্কী, সাকালিয়া, বার্বারী, হাবশী, সুদানী এবং কিবতীদেরকে তথা দুনিয়ার সমস্ত গৌর ও কৃষ্ণ বর্ণের লোককে বশীভূত করে ফেলেন। এভাবে তারা আল্লাহর কালেমাকে সমুচ্চ করেন, সত্য দ্বীনকে ছড়িয়ে দেন এবং ইসলামী হুকুমত বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে পৌঁছিয়ে দেন। মহান আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন এবং তাঁদেরকেও সন্তুষ্ট রাখুন। দেখে বিস্মিত হতে হয় যে, তাঁরা ত্রিশ বছরের মধ্যে দুনিয়ার মানচিত্র পরিবর্তন করে দেন এবং ইতিহাসের পৃষ্ঠা পরিবর্তিত করেন। আল্লাহ আমাদেরকেও তাঁদেরই দলভুক্ত করুন। তিনি পরমদাতা ও করুণাময়।