বনী ইসরাঈল আয়াত ১৫
مَنِ اهْتَدٰى فَاِنَّمَا يَهْتَدِيْ لِنَفْسِهٖۚ وَمَنْ ضَلَّ فَاِنَّمَا يَضِلُّ عَلَيْهَاۗ وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِّزْرَ اُخْرٰىۗ وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِيْنَ حَتّٰى نَبْعَثَ رَسُوْلًا ( الإسراء: ١٥ )
Manihtadaa fa innamaa yahtadee linafsihee wa man dalla fa innamaa yadillu 'alaihaa; wa laa taziru waaziratunw wizra ukhraa; wa maa kunnaa mu'azzibeena hatta nab'asa Rasoola (al-ʾIsrāʾ ১৭:১৫)
English Sahih:
Whoever is guided is only guided for [the benefit of] his soul. And whoever errs only errs against it. And no bearer of burdens will bear the burden of another. And never would We punish until We sent a messenger. (Al-Isra [17] : 15)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
যে সঠিক পথে চলবে সে তার নিজের কল্যাণের জন্যই সঠিক পথে চলবে, আর যে গুমরাহ হবে তার গুমরাহীর পরিণাম তার নিজের উপরেই পড়বে। কোন বোঝা বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করবে না। আমি ‘আযাব দেই না যতক্ষণ একজন রসূল না পাঠাই। (বনী ইসরাঈল [১৭] : ১৫)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
যারা সৎপথ অবলম্বন করবে, তারা তো নিজেদেরই মঙ্গলের জন্যই সৎপথ অবলম্বন করবে এবং যারা পথভ্রষ্ট হবে, তারা নিজেদেরই ধ্বংসের জন্যই হবে এবং কেউ অন্য কারো ভার বহন করবে না।[১] আর আমি রসূল না পাঠানো পর্যন্ত কাউকে শাস্তি দিই না। [২]
[১] অবশ্য যে নিজে ভ্রষ্ট এবং অপরকেও ভ্রষ্ট করবে, সে নিজের ভ্রষ্টতার বোঝার সাথে সাথে যাদেরকে সে স্বীয় প্রচেষ্টায় ভ্রষ্ট করেছে, তাদের গুনাহের বোঝাও (তাদের গুনাহতে কোন কমতি না করেই) তাকে বহন করতে হবে। এ কথা কুরআনের অন্য কয়েকটি স্থানে এবং বহু হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। আর প্রকৃতপক্ষে এটা হবে তাদেরই গুনাহের বোঝা যা অন্যদেরকে ভ্রষ্ট করে তারা অর্জন করেছে।
[২] কোন কোন মুফাসসির এ থেকে কেবল পার্থিব শাস্তিকে বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ, আখেরাতের আযাব থেকে স্বতন্ত্র হবে না। কিন্তু কুরআনে কারীমের অন্যান্য আয়াত থেকে এ কথা পরিষ্কার হয় যে, মহান আল্লাহ মানুষদেরকে জিজ্ঞাসা করবেন যে, তোমাদের কাছে কি আমার রসূল আসেনি? তারা ইতিবাচক উত্তর দিবে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, রসূল প্রেরণ এবং গ্রন্থ অবতরণ ছাড়া তিনি কাউকে আযাব দেবেন না। তবে কোন্ জাতি বা কোন্ ব্যক্তির কাছে তাঁর বার্তা পৌঁছেনি, সে ফায়সালা কিয়ামতের দিন তিনিই করবেন। সেখানে অবশ্যই কারো সাথে অবিচার করা হবে না। বধির, পাগল, নির্বোধ এবং দুই নবীর মধ্যবর্তী যুগে মৃত্যুবরণকারী (যাদের নিকট দ্বীনের খবর একেবারেই অজানা সেই) ব্যক্তিদের ব্যাপারও অনুরূপ। এদের ব্যাপারে কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তাদের প্রতি ফিরিশতা পাঠাবেন এবং ফিরিশতারা তাদেরকে বলবেন যে, 'জাহান্নামে প্রবেশ কর।' অতএব তারা যদি আল্লাহর এই নির্দেশকে মেনে নিয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করে যায়, তাহলে জাহান্নাম তাদের জন্য ফুল বাগান হয়ে যাবে। অন্যথা তাদেরকে টানতে টানতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (মুসনাদ আহমদ ৪/২৪, ইবনে হিব্বান ৯/২২৬, সহীহুল জামে' ৮৮১নং) মুসলিম শিশুরা জান্নাতে যাবে। তবে কাফের ও মুশরিকদের শিশুদের ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে নীরব থেকেছেন। কেউ কেউ জান্নাতে যাওয়ার এবং জাহান্নামে যাওয়ার অভিমত পেশ করেছেন। ইমাম ইবনে কাসীর বলেছেন, হাশরের মাঠে তাদের পরীক্ষা নেওয়া হবে। যারা আল্লাহর নির্দেশের আনুগত্য করবে, তারা জান্নাতে এবং যারা অবাধ্যতা করবে, তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। তিনি (ইবনে কাসীর) এই উক্তিকেই প্রাধান্য দিয়ে বলেন যে, এর ফলে পরস্পর বিরোধী বর্ণনাগুলোর মধ্যে সমবয় সাধন করা যায়। (বিস্তারিত জানার জন্য তাফসীর ইবনে কাসীর দ্রষ্টব্য) তবে সহীহ বুখারীর বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মুশরিকদের শিশুরাও জান্নাতে প্রবেশ করবে।
(দ্রষ্টব্যঃ সহীহ বুখারী ৩/২৫৭, ১২/৩৪৮ ফাতহুল বারী সহ)
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
যে সৎপথ অবলম্বন করবে সে তো নিজেরই মঙ্গলের জন্য সৎপথ অবলম্বন করে এবং যে পথভ্রষ্ট হবে সে তো পথভ্রষ্ট হবে নিজেরই ধ্বংসের জন্য [১]। আর কোন বহনকারী অন্য কারো ভার বহন করবে না [২]। আর আমরা রাসুল না পাঠানো পর্যন্ত শাস্তি প্রদানকারী নই [৩]।
[১] অর্থাৎ সৎ ও সত্য-সঠিক পথ অবলম্বন করে কোন ব্যক্তি আল্লাহ, রসূল বা সংশোধন প্রচেষ্টা পরিচালনাকারীদের প্রতি কোন অনুগ্রহ করে না বরং সে তার নিজেরই কল্যাণ করে। অনুরূপভাবে ভুল পথ অবলম্বন করে অথবা তার উপর অনড় থেকে কোন ব্যক্তি অন্যের ক্ষতি করে না, নিজেরই ক্ষতি করে। [আদওয়াউল বায়ান] আল্লাহর রাসূল ও সত্যের আহবায়কগণ মানুষকে ভুল পথ থেকে বাঁচাবার এবং সঠিক পথ দেখাবার জন্য যে প্রচেষ্টা চালান তা নিজের কোন স্বার্থে নয় বরং মানবতার কল্যাণার্থেই চালান। কুরআনের অন্যত্রও আল্লাহ তা'আলা তা বলেছেন, যেমন, “যে সৎ কাজ করে সে তার নিজের কল্যাণের জন্যই তা করে এবং কেউ মন্দ কাজ করলে তার প্রতিফল সে-ই ভোগ করবে। আপনার রব তাঁর বান্দাদের প্রতি মোটেই যুলুমকারী নন।” [সূরা ফুসসিলাত; ৪৬; সূরা আল-জাসিয়াহ; ১৫]
আরও বলেন, “যে কুফরী করে কুফরীর শাস্তি তারই প্ৰাপ্য; আর যারা সৎ কাজ করে তারা নিজেদেরই জন্য রচনা করে সুখ শয্যা। ” [সূরা আর-রূম; ৪৪]
আরও বলেন, “অবশ্যই তোমাদের রব এর কাছ থেকে তোমাদের কাছে চাক্ষুষ প্রমাণাদি এসেছে। অতঃপর কেউ চক্ষুষ্মান হলে সেটা দ্বারা সে নিজেই লাভবান হবে, আর কেউ অন্ধ সাজলে তাতে সে নিজেই ক্ষতিগ্ৰস্ত হবে। আর আমি তোমাদের উপর সংরক্ষক নই। ” [সূরা আল-আন’আম; ১০৪]
আরও বলেন, “যে সৎ পথ অবলম্বন করে সে তা করে নিজেরই কল্যাণের জন্য এবং যে বিপথগামী হয় সে তো বিপথগামী হয় নিজেরই ধ্বংসের জন্য আর আপনি তাদের তত্ত্বাবধায়ক নন। ” [সুরা আয-যুমার; ৪১]
[২] এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক সত্য। কুরআন মজীদে বিভিন্ন স্থানে এ সত্যটি বুঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে। কারণ এটি না বুঝা পর্যন্ত মানুষের কার্যধারা কখনো সঠিক নিয়মে চলতে পারে না। এ বাক্যের অর্থ হচ্ছে, প্ৰত্যেক ব্যক্তির একটি স্বতন্ত্র নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। নিজের ব্যক্তিগত পর্যায়ে আল্লাহর সামনে এ জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে। এ ব্যক্তিগত দায়িত্বের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি তার সাথে শরীক নেই। তবে অন্যত্র যে বলা হয়েছে, “ওরা নিজেদের ভার বহন করবে এবং নিজেদের বোঝার সাথে আরো কিছু বোঝা” (সূরা আল-আনকাবুত; ১৩]
এবং আরও যে এসেছে, “ফলে কিয়ামতের দিন তারা বহন করবে তাদের পাপের বোঝা পূর্ণ মাত্রায় এবং তাদের ও পাপের বোঝা যাদেরকে তারা অজ্ঞতাবশত বিভ্ৰান্ত করেছে”। [সূরা আন-নাহল; ২৫]
আয়াতদ্বয় এ আয়াতে বর্ণিত মৌলিক সত্যের বিরোধী নয়। কারণ তারা খারাপ কাজের প্রতি মানুষকে আহবান করে তাদের নিজেদেরকেই কলুষিত করেছে। তাই তারা অন্যের বোঝাকে নিজেদের বোঝা হিসেবে বহন করবে। অন্যের বোঝা হিসেবে বহন করবে না। এটা বান্দাদের সাথে আল্লাহর রহমত ও ইনসাফেরই বহিঃ প্রকাশ [দেখুন, ইবন কাসীর]
[৩] তবে এ ধরনের আয়াত পড়ে যাদের কাছে কোন নবীর পয়গাম পৌঁছেনি। তাদের অবস্থান কোথায় হবে, এ প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামানোর চেয়ে একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তির চিন্তা করা উচিত, তার নিজের কাছে তো পয়গাম পৌঁছে গেছে, এখন তার অবস্থা কি হবে? আর অন্যের ব্যাপারে বলা যায়, কার কাছে, কবে, কিভাবে এবং কি পরিমাণ আল্লাহর পয়গাম পৌছেছে এসে তার সাথে কি আচরণ করেছে এবং কেন করেছে তা আল্লাহই ভালো জানেন। আলেমুল গায়েব ছাড়া কেউ বলতে পারেন না। কার উপর আল্লাহর প্রমাণ পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং কার উপর হয়নি। এ ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা হলো, নাবালক বাচ্চাদের নিয়ে। তাদের কি হুকুম হবে? এ ব্যাপারে স্পষ্ট কথা হলো এই যে, মুমিনদের সন্তানগণ জান্নাতি হবে। কিন্তু কাফের মুশরিকদের সন্তানদের ব্যাপারে আলেমগণ বিভিন্ন হাদীসের কারণে সর্বমোট চারটি মতে বিভক্ত হয়েছেঃ
১) তারা জান্নাতে যাবে। এ মতের সপক্ষে তারা এ আয়াত এবং সহীহ বুখারীর এক হাদীস [৪০৪৭] দ্বারা দলীল পেশ করে থাকেন। অনুরূপ কিছু হাদীস মুসনাদে আহমাদ [৫/৫৮] ও মাজমাউয-যাওয়ায়েদ [৭/২১৯] ও এসেছে।
২) তাদের সম্পর্কে কোন কিছু বলা যাবে না। এ মতের সপক্ষে ও সহীহ বুখারীর এক হাদীস [৩৮৩১, ৪৮৩১] থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়।
৩) তারা তাদের পিতাদের অনুগমণ করবে। মুসনাদে আহমদে [৬/৪৮] বর্ণিত হাদীস থেকে এমতের সমর্থন পাওয়া যায়।
৪) তাদের কে হাশরের মাঠে পরীক্ষা করা হবে। সে পরীক্ষায় যারা পাশ করবে তারা হবে জান্নাতি। আর পাশ না করলে হবে জাহান্নামি। এমতটি সবচেয়ে বেশী গ্রহণযোগ্য মত। এ ব্যাপারে মুসনাদে আহমাদের [৪/২৪] এক হাদীস থেকে প্রমাণ পাই। সত্যাম্বেষী আলেমগণ এমতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। ইবন কাসীর এ ব্যাপারে আরও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। [ইবন কাসীর]
3 Tafsir Bayaan Foundation
যে হিদায়াত গ্রহণ করে, সে তো নিজের জন্যই হিদায়াত গ্রহণ করে এবং যে পথভ্রষ্ট হয় সে নিজের (স্বার্থের) বিরুদ্ধেই পথভ্রষ্ট হয়। আর কোন বহনকারী অপরের (পাপের) বোঝা বহন করবে না। আর রাসূল প্রেরণ না করা পর্যন্ত আমি আযাবদাতা নই।
4 Muhiuddin Khan
যে কেউ সৎপথে চলে, তারা নিজের মঙ্গলের জন্যেই সৎ পথে চলে। আর যে পথভ্রষ্ট হয়, তারা নিজের অমঙ্গলের জন্যেই পথ ভ্রষ্ট হয়। কেউ অপরের বোঝা বহন করবে না। কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকেই শাস্তি দান করি না।
5 Zohurul Hoque
যে কেউ সঠিক পথে চলে সে তো তবে নিজের জন্যেই সঠিক পথ ধরে, আর যে বিপথে যায় সে তো তবে নিজের বিরুদ্ধেই বিপথে চলে। আর একজন বোঝা বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করবে না। আর আমরা শাস্তিদাতা নই যে পর্যন্ত না আমরা কোনো রসূল পাঠিয়েছি।
6 Mufti Taqi Usmani
যে ব্যক্তি সরল পথে চলে, সে তো সরল পথে চলে নিজ মঙ্গলের জন্যই আর যে ব্যক্তি ভ্রান্ত পথ অবলম্বন করে, সে নিজের ক্ষতির জন্যই তা অবলম্বন করে। কোনও ভার বহনকারী অন্য কারও ভার বহন করবে না। আমি কখনও কাউকে শাস্তি দেই না, যতক্ষণ না (তার কাছে) কোন রাসূল পাঠাই।
7 Mujibur Rahman
যারা সৎ পথ অবলম্বন করবে তারাতো নিজেদেরই মঙ্গলের জন্য তা অবলম্বন করবে এবং যারা পথভ্রষ্ট হবে তারাতো পথভ্রষ্ট হবে নিজেদেরই ধ্বংসের জন্য এবং কেহ অন্য কারও ভার বহন করবেনা; আমি রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত কেহকেও শাস্তি দিইনা।
8 Tafsir Fathul Mazid
১৫ নং আয়াতের তাফসীর:
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করেছেন, যে ব্যক্তি সৎ পথের অনুসরণ করবে, তাঁর উত্তম প্রতিদান নিজেই ভোগ করবে। আর যে অসৎ পথের অনুসরণ করলে সে নিজেকেই পথভ্রষ্ট করল এবং জাহান্নামের দিকে ঠেলে দিল, এতে অন্য কেউ দায়ী নয়। নিজের পাপের বোঝা নিজেকেই বহন করতে হবে, অন্য কেউ বহন করবে না। এরূপ অনেক আয়াত রয়েছে, যেমন সূরা ফাতিরের ১৮ নং, সূরা আন‘আমের ১৬৪ নং এবং সূরা বাকারাহর ১৩৪ নং আয়াত। তবে যে নিজে পথভ্রষ্ট হয় এবং অন্যকেও ভ্রষ্ট করে সে তার নিজের ভ্রষ্টতার বোঝা বহন করবে এবং যাদেরকে ভ্রষ্ট করেছে তাদের গুনাহর বোঝাও (তাদের গুনাহর কোন কমতি না করেই) তাকে বহন করতে হবে। এ কথাও কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(لِيَحْمِلُوْآ أَوْزَارَهُمْ كَامِلَةً يَّوْمَ الْقِيٰمَةِ لا وَمِنْ أَوْزَارِ الَّذِيْنَ يُضِلُّوْنَهُمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ ط أَلَا سَا۬ءَ مَا يَزِرُوْنَ)
“ফলে কিয়ামত দিবসে তারা বহন করবে তাদের পাপভার পূর্ণ মাত্রায় এবং পাপভার তাদেরও যাদেরকে তারা অজ্ঞতাহেতু পথভ্রষ্ট করেছে। দেখ, তারা যা বহন করবে তা কত নিকৃষ্ট!” (সূরা নাহল ১৬:২৫)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
مَنْ دَعَا إِلَي هُدًي، كَانَ لَهُ مِنَ الْأَجْرِ مِثْلُ أُجُورِ مَنْ تَبِعَهُ، لَا يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْئًا، وَمَنْ دَعَا إِلَي ضَلَالَةٍ، كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الْإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ، لَا يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئًا
যে ব্যক্তি সৎ পথের দিকে মানুষকে আহ্বান করবে সে ব্যক্তি তেমন প্রতিদান পাবে যেমন প্রতিদান সে সৎপথের অনুসরণকারী পাবে, তাদের কারো প্রতিদান কম করা হবে না। আর যে ব্যক্তি কোন পথভ্রষ্টতার দিকে আহ্বান করবে সে ব্যক্তি তেমন গুনাহগার হবে যেমন গুনাহগার হবে সে ভ্রষ্টতার অনুসারী ব্যক্তি, তাদের কারো গুনাহ কমিয়ে দেয়া হবে না। (সহীহ মুসলিম হা: ২৬৭৪)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা মানুষের প্রতি তাঁর একটি রহমতের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তিনি রাসূল প্রেরণ করে সত্য-মিথ্যা ও শরীয়ত সম্পর্কে অবগত না করা পর্যন্ত কোন জাতিকে ধ্বংস করেন না।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: (رُسُلاً مُّبَشِّرِيْنَ وَمُنْذِرِيْنَ لِئَلَّا يَكُوْنَ لِلنَّاسِ عَلَي اللّٰهِ حُجَّةٌۭ بَعْدَ الرُّسُلِ ط وَكَانَ اللّٰهُ عَزِيْزًا حَكِيْمًا) “সুসংবাদদাতা ও সাবধানকারী রাসূল প্রেরণ করেছি, যাতে রাসূল আসার পর আল্লাহর বিরুদ্ধে মানুষের কোন অভিযোগ না থাকে। আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (সূরা নিসা ৪:১৬৫)
যারাই জাহান্নামে যাবে তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে, তোমাদের কাছে কি কোন রাসূল আগমন করেনি? সবাই স্বীকার করবে,
যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,
(کُلَّمَآ اُلْقِیَ فِیْھَا فَوْجٌ سَاَلَھُمْ خَزَنَتُھَآ اَلَمْ یَاْتِکُمْ نَذِیْرٌﭗ قَالُوْا بَلٰی قَدْ جَا۬ءَنَا نَذِیْرٌﺃ فَکَذَّبْنَا وَقُلْنَا مَا نَزَّلَ اللہُ مِنْ شَیْءٍﺊ اِنْ اَنْتُمْ اِلَّا فِیْ ضَلٰلٍ کَبِیْرٍﭘ)
“যখনই তাতে কোন দলকে নিক্ষেপ করা হবে, তখনই তাদেরকে জাহান্নামের রক্ষীরা জিজ্ঞেস করবেঃ তোমাদের নিকট কি কোন সতর্ককারী আসেনি? তারা উত্তরে বলবে: হ্যাঁ আমাদের নিকট সতর্ককারী এসেছিল, আমরা তাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিলাম এবং বলেছিলাম: আল্লাহ কিছুই নাযিল করেনি, তোমরা তো মহা গুমরাহীতে রয়েছ।” (সূরা মুলক ৬৭:৮-৯)
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, রাসূল প্রেরণ ও কিতাব অবতরণ ছাড়া আল্লাহ তা‘আলা কোন জাতিকে আযাব দিবেন না। তবে যদি কোন্ জাতি বা কোন্ ব্যক্তির কাছে তাঁর বার্তা না পৌঁছে, সে ফায়সালা কিয়ামতের দিন তিনিই করবেন। সেখানে অবশ্যই কারো সাথে অবিচার করা হবে না। বধির, পাগল, নির্বোধ এবং দু’নাবীর মধ্যবর্তী যুগে মৃত্যুবরণকারী (যাদের কাছে দীনের দাওয়াত পৌঁছে নাই) ব্যক্তিদের ব্যাপারও। এদের ব্যাপারে কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রতি ফেরেশতা প্রেরণ করবেন এবং ফেরেশতারা তাদেরকে বলবেন যে, জাহান্নামে প্রবেশ কর। অতএব তারা যদি আল্লাহ তা‘আলার এ নির্দেশ মেনে নিয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করে তাহলে জাহান্নাম তাদের জন্য ফুল বাগান হয়ে যাবে। অন্যথায় তাদেরকে টানতে টানতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (সহীহুল জামে হা: ৮৮১, ইবনু হিব্বান ৯/২২৬)
মুসলিম শিশুরা জান্নাতে যাবে তবে কাফির-মুশরিকদের শিশুদের ব্যাপারে মতামত রয়েছে। কেউ বলেছেন, জান্নাতে যাবে; কেউ বলেছেন জাহান্নামে যাবে। ইমাম ইবনু কাসীর বলেন: হাশরের মাঠে তাদের পরীক্ষা করা হবে, যারা আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশের আনুগত্য করবে তারা জান্নাতে যাবে, আর যারা অবাধ্য হবে তারা জাহান্নামে যাবে। (ইবনু কাসীর) ইমাম বুখারী যে বর্ণনা নিয়ে এসেছেন তাতে বুঝা যায় কাফির-মুশরিকদের শিশুরাও জাহ্ন্নাামে যাবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. প্রত্যেক মানুষ তার নিজের পাপ বহন করবে। কেউ কারো পাপ বহন করবে না, তবে অন্যকে পাপের দিকে আহ্বান করলে অনুসারী ব্যক্তির সমান পাপের ভার বহন করতে হবে।
২. আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সতর্ক না করা পর্যন্ত শাস্তি দেন না।
৩. আল্লাহ তা‘আলার দয়া/রহমত নামে একটি সিফাত আছে তা জানা গেল।
9 Fozlur Rahman
যে সৎপথে চলে সে নিজের কল্যাণের জন্যই সৎপথে চলে। আবার যে বিপথগামী হয় সে নিজের অকল্যাণের জন্যই বিপথগামী হয়। একজন আরেকজনের ভার বহন করে না। আর রসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি (কাউকে) শাস্তি দেই না।
10 Mokhtasar Bangla
১৫. বস্তুতঃ যে ব্যক্তি ঈমানের দিশা পেলো তার হিদায়েতের প্রতিদান সে নিজেই পাবে আর যে ব্যক্তি পথভ্রষ্ট হলো তার ভ্রষ্টতার শাস্তি সে নিজেই ভোগ করবে। বস্তুতঃ কোন ব্যক্তি অন্য কারো গুনাহের বোঝা বহন করবে না। আর আমি কোন জাতিকে শাস্তি দেই না যতক্ষণ না রাসূলগণকে পাঠিয়ে তাদের উপর আমার প্রমাণাদি উপস্থাপন করি।
11 Tafsir Ibn Kathir
আল্লাহ তাআলা বলেন যে, যে ব্যক্তি সৎপথ অবলম্বন করে, সত্যের অনুসরণ করে এবং নুবুওয়াতকে স্বীকার করে, এটা তার নিজের জন্যেই কল্যাণকর হয়। আর যে ব্যক্তি সত্যপথ থেকে সরে যায়, সঠিক রাস্তা থেকে। ফিরে আসে, এর শাস্তি তাকেই ভোগ করতে হবে। কাউকেও কারো পাপের কারণে পাকড়াও করা হবে না। প্রত্যেকের আমল তার সাথেই রয়েছে। এমন কেউ হবে না যে অপরের বোঝা বহন করবে। আর কুরআন কারীমে যে রয়েছেঃ وَ لَیَحْمِلُنَّ اَثْقَالَهُمْ وَ اَثْقَالًا مَّعَ اَثْقَالِهِمْ٘ অর্থাৎ “অবশ্যই তারা তাদের বোঝা বহন করবে এবং তার বোঝার সাথে। অন্য বোঝাও বহন করবে।” (২৯:১৩) আর এক জায়গায় আছেঃ وَمِنْ اَوْزَارِ الَّذِیْنَ یُضِلُّوْنَهُمْ بِغَیْرِ عِلْمٍ অর্থাৎ তারা নিজেদের বোঝার সাথে ওদের বোঝাও বহন করবে যাদেরকে জেনে তারা পথভ্রষ্ট করতো।” (১৬:২৫) এই দুই বিষয়ে কোন বৈপরিত্য মনে করা ঠিক নয়। কেননা, যারা অপরকে পথভ্রষ্ট করে, তাদেরকে পথভ্রষ্ট করার পাপ বহন করতে হবে, এটা নয় যে, যাদেরকে পথভ্রষ্ট করা হয়েছে। তাদের পাপ হালকা করে তাদের বোঝা এদের উপর চাপিয়ে দেয়া হবে। আমাদের ন্যায় বিচারক আল্লাহ এইরূপ করতেই পারেন না।
এরপর মহান আল্লাহ নিজের একটি রহমতের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তিনি রাসূল প্রেরণ করার পূর্বে কোন উম্মতকে শাস্তি দেন না। সূরায়ে মুলকে রয়েছেঃ “যখন জাহান্নামে (কাফিরদের) কোন একটি দল নিক্ষিপ্ত হবে তখন ওর রক্ষকগণ তাদেরকে জিজ্ঞেস করবেঃ তোমাদের কাছে কি কোন ভয়। প্রদর্শনকারী (নবী) আগমন করেন নাই? তারা উত্তরে বলবেঃ নিশ্চয় আমাদের কাছে ভয় প্রদর্শনকারী এসেছিলেন, কিন্তু আমরা অবিশ্বাস করেছিলাম এবং বলেছিলামঃ আল্লাহ কিছুই নাযিল করেন নাই, আর তোমরা মহাভ্রমে পতিত। আছ।” আর এক জায়গায় রয়েছেঃ “যারা কাফির, তাদেরকে দলে দলে দুখের দিকে হাকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে এমন কি যখন তারা দুষখের নিকট পৌঁছবে, তখন ওর দ্বারসমূহ খুলে দেয়া হবে এবং ওর দ্বার রক্ষীগণ তাদেরকে বলবেঃ তোমাদের নিকট কি তোমাদের মধ্য হতে রাসূলগণ আগমন করেন নাই, যারা তোমাদের প্রতিপালকের আয়াতসমূহ তোমাদেরকে পাঠ করে শুনাতেন এবং তোমাদেরকে তোমাদের এই দিবসের আগমন সম্বন্ধে ভয় প্রদর্শন করতেন? তারা উত্তরে বলবেঃ হাঁ, (এসেছিলেন, কিন্তু (আমরা অমান্য করেছিলাম, ফলে) কাফিরদের জন্যে শাস্তির প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হয়ে রইলো।” অন্য একটি আয়াতে রয়েছেঃ “কাফিররা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হয়ে চীৎকার করে বলবেঃ হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এখান হতে বের করে নিন, আমরা আমাদের পূর্বের কৃতকর্ম ছেড়ে দিয়ে এখন ভাল কাজ করবো। তখন তাদেরকে বলা হবেঃ আমি কি তোমাদেরকে এতোটা বয়স দিই নাই যে, তোমরা উপদেশ গ্রহণ করার ইচ্ছা করতে পারতে? আর আমি কি তোমাদের মধ্যে আমার রাসূল পাঠাই নাই, যে তোমাদেরকে খুবই সতর্ক করতো? এখন তোমাদেরকে শাস্তি ভোগ করতেই হবে, যালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই।”
মোট কথা, আরো বহু আয়াত দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তাআ'লা রাসূল প্রেরণ না করে কাউকেও জাহান্নামে দেন না। সহীহ বুখারীতে اِنَّ رَحْمَتَ اللّٰهِ قَرِیْبٌ مِّنَ الْمُحْسِنِیْنَ “নিশ্চয় আল্লাহর রহমত সৎকর্মশীলদের নিকটবর্তী” (৭:৫৬) এই আয়াতের তাফসীরে একটি সুদীর্ঘ হাদীস বর্ণিত আছে, যেখানে বেহেস্ত ও দুযখের বাক্যালাপ রয়েছে। তারপর রয়েছে যে, জান্নাতের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা স্বীয় মাখলুকের মধ্যে কারো প্রতি জুলুম করবেন না আর তিনি জাহান্নামের জন্যে এক নতুন মাখলুক সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে ওর মধ্যে নিক্ষেপ করা হবে। জাহান্নাম বলতে থাকবেঃ ‘আরো বেশী কিছু আছে কি? এই ব্যাপারে আলেমগণ অনেক কিছু আলোচনা-সমালোচনা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এটা জান্নাতের ব্যাপারে রয়েছে। কেননা, জান্নাত হচ্ছে ফল বা অনুগ্রহের ঘর। আর জাহান্নাম হচ্ছে, আল বা ন্যায় বিচারের ঘর। ওযর খণ্ডন করা ও হুজ্জত প্রকাশ ছাড়া কাউকেও ওর মধ্যে প্রবিষ্ট করা হবে না। এ কারণেই হাদীসেরহাফিজদের একটি দলের ধারণা এই যে, এই ব্যাপারে বর্ণনাকারী উল্টোটা বর্ণনা করে ফেলেছেন। এর দলীল সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের ঐ রিওয়াইয়াতটি যাতে এই হাদীসেরই শেষাংশে রয়েছে যে, জাহান্নাম পূর্ণ হবে না, শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা স্বীয় পা’ তাতে রেখে দিবেন। এ সময় জাহান্নাম বলবেঃ ‘যথেষ্ট হয়েছে, যথেষ্ট হয়েছে। আর ঐ সময় ওটা পুরিপূর্ণ হয়ে যাবে এবং চারদিক কুঞ্চিত হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা কারো উপর জুলুম করেন না। হাঁ, তবে জান্নাতের জন্যে তিনি একটি নতুন মাখলুক সৃষ্টি করবেন।
বাকী থাকলো এখন এই মাসআলাটি যে, কাফিরদের যে নাবালক শিশু শৈশবেই মারা যায়, যারা পাগল অবস্থায় রয়েছে, যারা সম্পূর্ণরূপে বধির এবং যারা এমন যুগে কালাতিপাত করেছে যখন কোন নবী রাসূলের আগমন ঘটে নাই বা তারা দ্বীনের সঠিক শিক্ষা পায় নাই এবং তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে নাই এবং যারা জ্ঞানশূন্য বৃদ্ধ, এসব লোকদের হুকুম কি? এই ব্যাপারে প্রথম থেকেই মতভেদ চলে আসছে। এসম্পর্কে যেহাদীসগুলি রয়েছে সেগুলি আপনাদের সামনে বর্ণনা করছি। তারপর ইমামদের কথাগুলিও সংক্ষেপ বর্ণনা করবো ইনশা আল্লাহ।
প্রথম হাদীসঃ
মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, চার প্রকারের লোক কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার সাথে কথোপকথন করবে। প্রথম হলো বধির লোক, যে কিছুই শুনতে পায় না; দ্বিতীয় হলো সম্পূর্ণ নির্বোধ ও পাগল লোক, যে কিছুই জানে না। তৃতীয় হলো অত্যন্ত বৃদ্ধ, যার জ্ঞান লোপ পেয়েছে। চতুর্থ হলো ঐ ব্যক্তি যে এমন যুগে জীবন যাপন করেছে যে যুগে কোন নবী আগমন করেন নাই বা কোন ধর্মীয় শিক্ষাও বিদ্যমান ছিল না। বধির লোকটি বলবেঃ “ইসলাম এসেছিল, কিন্তু আমার কানে কোন শব্দ পৌঁছে নাই।” পাগল বলবেঃ “ইসলাম এসেছিল বটে, কিন্তু আমার অবস্থা তো এই ছিল যে, শিশুরা। আমার উপর গোবর নিক্ষেপ করতো।” বৃদ্ধ বলবেঃ “ইসলাম এসেছিল, কিন্তু আমার জ্ঞান সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছিল। আমি কিছুই বুঝতাম না।” আর যে লোকটির কাছে কোন রাসূলও আসে নাই এবং সে তাঁর কোন শিক্ষাও পায়। নাই সে বলবেঃ “আমার কাছে কোন রাসূলও আসেন নাই এবং আমি কোন হকও পাই নাই। সুতরাং আমি আমল করতাম কিরূপে?” তাদের এসব কথা শুনে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে নির্দেশ দিবেনঃ “আচ্ছা যাও, জাহান্নামে লাফিয়ে পড়।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! যদি তারা আল্লাহর আদেশ মেনে নেয় এবং জাহান্নামে ঝাপিড়ে পড়ে তবে জাহান্নামের আগুন তাদের জন্যে ঠাণ্ডা ও আরামদায়ক হয়ে যাবে।” অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, যারা জাহান্নামে লাফিয়ে পড়বে তাদের জন্য তা হয়ে যাবে ঠাণ্ডা ও শান্তিদায়ক। আর যারা বিরত থাকবে তাদেরকে হুকুম অমান্যের কারণে টেনে হেঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। ইমাম ইবনু জারীর (রঃ) এই হাদীসটি বর্ণনা করার পর হযরত আবু হুরাইরার (রাঃ) নিম্নের ঘোষণাটিও উল্লেখ করেছেনঃ “এর সত্যতার প্রমাণ হিসেবে তোমরা ইচ্ছা করলে আল্লাহ তাআলার وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِيْنَ ـ ـ ـ الخ এই কালিমাও পাঠ করতে পার।” অর্থাৎ “আমি শাস্তি প্রদানকারী নই যে পর্যন্ত না রাসূল প্রেরণ করি।”
দ্বিতীয় হাদীসঃ
হযরত আনাসকে (রাঃ) জিজ্ঞেস করা হয়ঃ “হে আবু হামযা (রাঃ) ! মুশরিকদের শিশুদের ব্যাপারে আপনি কি বলেন?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “আমি রাসূলুল্লাহকে (সঃ) বলতে শুনেছিঃ “তারা পাপী নয় যে, জাহান্নামে তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে এবং পূণ্যবানও নয় যে, জান্নাতে তাদেরকে প্রতিদান দেয়া হবে।” (এ হাদীসটি হযরত আবু দাউদ তায়ালেসী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
তৃতীয় হাদীসঃ
এই চার প্রকার লোকের ওযর শুনে মহান আল্লাহ বলবেনঃ “অন্যদের কাছে তো আমার রাসূল পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু তোমাদেরকে এখনই বলছিঃ যাও, তোমরা জাহান্নামে চলে যাও।” আল্লাহর ফরমান শুনে। জাহান্নাম থেকেও একটি গ্রীবা উঁচু হবে। এই নির্দেশ শোনা মাত্রই সৎ প্রকৃতির লোকেরা দৌড়িয়ে গিয়ে তাতে লাফিয়ে পড়বে। আর যারা অসৎ প্রকৃতির লোক তারা বলবেঃ “হে আল্লাহ! আমরা এর থেকে বাঁচবার জন্যেই তো এই ওযর পেশ করেছিলাম।” আল্লাহ তাআলা তখন বলবেনঃ “তোমরা যখন স্বয়ং আমার কথা মানছে না, তখন আমার রাসূলদের কথা কি করে মানতে? এখন। তোমাদের জন্য ফায়সালা এটাই যে, তোমরা জাহান্নামী।” আর ঐ আদেশ মান্যকারীদেরকে বলা হবেঃ “তোমরা অবশাই জান্নাতী। কারণ, তোমরা আমার কথা মান্য করেছে। (এই হাদীসটি মুসনাদে আবি ইয়ালায় বর্ণিত হয়েছে)
চতুর্থ হাদীসঃ
রাসূলুল্লাহকে (সঃ) মুসলমানদের সন্তানদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন যে, তারা তাদের সন্তানদের সাথেই থাকবে। অতঃপর তাঁকে মুশরিকদের সন্তানদের সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেনঃ “তারা তাদের পিতাদের সাথে থাকবে।” তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলোঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! তারা কোন আমল তো করে নাই?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “ হাঁ, তবে আল্লাহ তাআলা খুব ভাল ভাবেই জানেন।” (এ হাদীস আবু ইয়ালা মুসিলী (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন)
পঞ্চম হাদীসঃ
বর্ণিত আছে যে, কিয়ামতের দিন অজ্ঞ ও নির্বোধ লোকেরা নিজেদের বোঝা কোমরে বহন করে নিয়ে আসবে এবং আল্লাহ তাআলার সামনে ওযর পেশ করতঃ বলবেঃ “আমাদের কাছে কোন রাসূল আসেন নাই এবং আপনার কোন হুকুমও পৌঁছে নাই। এরূপ হলে আমরা মন খুলে আপনার কথা মেনে চলতাম।” তখন আল্লাহ তাআলা বলবেনঃ “আচ্ছা, এখন যা হুকুম করবো তা মানবে তো?” উত্তরে তারা বলবেঃ “হাঁ, অবশ্যই বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিবো।” তখন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলবেনঃ আচ্ছা যাও, জাহান্নামের পার্শ্বে গিয়ে তাতে প্রবেশ কর।” তারা তখন অগ্রসর হয়ে জাহান্নামের পার্শ্বে পৌঁছে যাবে। সেখানে গিয়ে যখন ওর উত্তেজনা, শব্দ এবং শাস্তি দেখবে তখন ফিরে আসবে এবং বলবেঃ “হে আল্লাহ আমাদেরকে এর থেকে রক্ষা করুন।” আল্লাহ তাআলা বলবেনঃ “দেখো, তোমরা অঙ্গীকার করেছো যে, আমার হুকুম মানবে, আবার এই নাফরমানী কেন?” তারা উত্তরে বলবেঃ“আচ্ছা, এবার মানবো।” অতঃপর তাদের কাছ থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার নেয়া হবে। তারপর এরা ফিরে এসে বলবেঃ “হে আল্লাহ! আমরা তো ভয় পেয়ে গেছি। আমাদের দ্বারা তো আপনার এই আদেশ মান্য করা সম্ভব নয়।” তখন প্রবল প্রতাপান্বিত আল্লাহ বলবেনঃ “তোমরা নাফরমানী করেছো। সুতরাং এখন লাঞ্ছনার সাথে জাহান্নামী হয়ে যাও।” রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেন যে, প্রথমবার তারা যদি আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী জাহান্নামে লাফিয়ে পড়তো তবে ওর অগ্নি তাদের জন্যে ঠাণ্ডা হয়ে যেতো এবং তাদের দেহের একটি নোমও পুড়তো না। (এই হাদীসটি হাফিজ আবু বকর আহমদ ইবনু আবদিল খালেক বাযযার (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন যে, এই হাদীসের মতন পরিচিত নয়। আবু আইয়ূব (রঃ) হতে শুধু আব্বাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং আব্বাদ (রঃ) হতে শুধু রাইহান ইবনু সাঈদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। আমি (ইবনু কাসীর) বলি যে, এটাই ইবনু হাব্বান রঃ) নির্ভরযোগ্য রূপে বর্ণনা করেছেন। ইয়াহইয়া ইবনু মুঈন (রঃ) এবং নাসায়ী (রঃ) বলেন যে, এতে ভয়ের কোন কারণ নেই। আবু দাউদ (রঃ) তাদের থেকে বর্ণনা করেন নাই। আবু হাতিম (রাঃ) বলেন যে, ইনি শায়েখ। তার মধ্যে কোন ত্রুটি নেই। তাঁর হাদীসগুলি লিখে নেয়া হয়, কিন্তু তার থেকে দলীল গ্রহণ করা হয় না)
ষষ্ঠ হাদীসঃ
ইমাম মুহাম্মদ ইবনু ইয়াহইয়া যাহলী (রঃ) রিওয়াইয়াত এনেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, “নবী শূন্য যুগের লোক, পাগল এবং শিশু আল্লাহ তাআলার সামনে আসবে। প্রথম জন (নবী শূন্য যুগের লোক) বলবেঃ “আমার নিকট তো আপনার কিতাবই পৌঁছে নাই।” পাগল বলবেঃ “আমার তো ভাল ও মন্দের মধ্যে পাথর্ক্য করার কোন জ্ঞানই ছিল না।” শিশু বলবেঃ “আমি তো বোধশক্তি লাভের সময়ই পাই নাই।” তৎক্ষণাৎ তাদের সামনে লেলিহান শিখাযুক্ত আগুন আনয়ন করা হবে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা বলবেনঃ “এতে প্রবেশ কর।” তখন এদের মধ্যে যারা সৎকার্য সম্পাদনকারী হতো তারা তো সাথে সাথেই আদেশ পালন করবে। আর যারা এই ওযর পেশ করার পরেও হঠকারিতা করতঃ আদেশ লংঘন করবে তাদেরকে আল্লাহ তাআলা বলবেনঃ “তোমরা আমার সামনেই যখন আমার আদেশ পালন করলে না, তখন আমার নবীদের কথা কি করে মানতে?”
সপ্তম হাদীসঃ
এ হাদীসটি ঐ তিন ব্যক্তির ব্যাপারে উপরোক্ত হাদীসগুলির মতই। এতে এও রয়েছে যে, যখন এরা জাহান্নামের পার্শ্বে যাবে তখন ওর থেকে এমন উঁচু হয়ে শিখা উঠবে যে, তারা মনে করবে, এটা তো সারা দুনিয়াকে জ্বালিয়ে ভগ্ন করে দিবে। এরূপ মনে করে তারা দৌড়িয়ে ফিরে আসবে। দ্বিতীয় বারও এটাই ঘটবে।
তখন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলবেনঃ “তোমাদের সৃষ্টির পূর্বেই তোমাদের আমল সম্পর্কে আমি অবহিত ছিলাম। আমার অবগতি থাকা সত্ত্বেও আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলাম। আমার অবগতি মোতাবেকই তোমরা হয়ে গেলে। সুতরাং হে জাহান্নাম! এদেরকে গ্রাস কর।” তৎক্ষণাৎ ঐ জ্বলন্ত অগ্নি তাদেরকে গ্রাস করে ফেলবে।
অষ্টম হাদীসঃ
উপরে বর্ণিত লোকদের উক্তি সহ হযরত আবু হুরাইরার (রাঃ) রিওয়াইয়াত পূর্বে বর্ণিত হয়েছে। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে তাঁর থেকেই বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “প্রত্যেক শিশু দ্বীনে ইসলামের উপরই সৃষ্টি হয়ে থাকে। অতঃপর তার পিতামাতা তাকে ইয়াহূদী, খৃস্টান এবং মাজুসী বানিয়ে দেয়। যেমন বকরীর নিখুঁত অঙ্গ বিশিষ্ট বাচ্চার কান কাটা হয়ে থাকে। জনগণ জিজ্ঞেস করলোঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! যদি সে শৈশবেই মারা যায়?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “তাদের আমল সম্পর্কে আল্লাহ তাআ'লার সঠিক ও পূর্ণ অবগতি ছিল।” মুসনাদের হাদীসে রয়েছে যে, জান্নাতে মুসলমান শিশুদের দায়িত্ব হযরত ইবরাহীমের (আঃ) উপর অর্পিত রয়েছে। সহীহ মুসলিমের হাদীসে কুদসীতে রয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “আমি আমার বান্দাদেরকে একত্ববাদী, একনিষ্ঠ এবং খাঁটি বানিয়েছি।” অন্য রিওয়াইয়াতে মুসলমান’ শব্দটিও রয়েছে।
নবম হাদীসঃ
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “প্রত্যেক শিশু ফিতরাতের (প্রকৃতির উপর জন্ম গ্রহণ করে থাকে।” জনগণ তখন উচ্চ স্বরে তাঁকে জিজ্ঞেস করেনঃ “মুশরিকদের শিশুরাও কি?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “মুশরিকদের শিশুরাও।” (এ হাদীসটি হাফিয আবু বকর বরকানী (রঃ) তার আল-মুসতাখরিজু আলাল বুখারী নামক গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন যে, মুশরিকদের শিশুদেরকে জান্নাতবাসীদের খাদেম বানানো হবে। (এ হাদীসটি ইমাম তিবরাণী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
দশম হাদীসঃ
একজন সাহাবী জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! জান্নাতে কারা কারা যাবে?” জবাবে তিনি বলেনঃ “শহীদ, শিশু এবং জীবন্ত প্রোথিত শিশুরা।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন) আলেমদের কারো কারো মাযহাব এই, তাদের ব্যাপারে নীরবতার ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের দলীলও গত হয়েছে। কেউ কেউ বলেন যে, তারা জান্নাতী। তাঁদের দলীল হচ্ছে সহীহ বুখারীর এ হাদীসটি যা হযরত সামুরা ইবনু জুনদুব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, মিরাজের রাত্রে রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি লোককে গাছের নীচে দেখতে পান যার পাশে অনেক শিশু ছিল। হযরত জিবরাঈলকে (আঃ) এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃ “ইনি হলেন হযরত ইবরাহীম (আঃ)। আর তাঁর পাশে যে শিশুগুলি রয়েছে তারা হচ্ছে। মুসলমান ও মুশরিকদের সন্তান।” “জনগণ তখন রাসূলুল্লাহকে (সঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! তাহলে মুশরিকদের সন্তানরাও কি (জান্নাতী)?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “হাঁ, মুশরিকদের সন্তানরাও (জান্নাতী)।”
কোন কোন আলেম বলেন যে, মুশরিকদের শিশুরা জাহান্নামী। কেননা, একটি হাদীসে রয়েছে যে, তারা তাদের পিতাদের সঙ্গে থাকবে। কেউ কেউ বলেন যে, কিয়ামতের মাঠে তাদের পরীক্ষা হয়ে যাবে। অনুগতরা জান্নাতে যাবে। আল্লাহ তাআলা নিজের পূর্ব ইলম প্রকাশ করতঃ তাদেরকে জান্নাতে প্রবিষ্ট করবেন। আর কেউ কেউ তাদের অবাধ্যতার কারণে জাহান্নামে যাবে। এখানেও আল্লাহ তাআলা স্বীয় পূর্ব জ্ঞান প্রকাশ করতঃ তাদেরকে জাহান্নামে প্রবিষ্ট করার নির্দেশ দিবেন। শায়েখ আবুল হাসান ইবনু ইসমাঈল আশআরী (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মাযহাব এটাই। ইমাম বায়হাকী (রঃ) কিতাবুল ই'তেকদি' নামক গ্রন্থে এর পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। আরো বহু মুহাককিক আলেম ও পরীক্ষক হাফিয এটাই বলেছেন। শায়েখ আবূ উমার ইবনু আবদিল বরানমারী (রঃ) পরীক্ষার কতকগুলি রিওয়াইয়াত বর্ণনা করার পর লিখেছেন যে, এই ব্যাপারে হাদীস গুলি মযবুত নয়। সুতরাং এগুলো দ্বারা হুজ্জত সাব্যস্ত হয় না এবং আহলে ইলম এগুলো অস্বীকার করেন। কেননা, আখেরাত হচ্ছে প্রতিদানের জায়গা, আমলের জায়গা নয় এবং পরীক্ষার জায়গাও নয়। আর জাহান্নামে যাওয়ার হুকুমও মানবিক শক্তির বাইরের হুকুম এবং মহান আল্লাহর অভ্যাস এটা নয়।
ইমাম সাহেবের এই উক্তিটির জবাব শুনুন! এই ব্যাপারে যে সব হাদীস এসেছে সেগুলির মধ্যে কতকগুলি তো সম্পূর্ণরূপে বিশুদ্ধ, যেমন আইম্মায়ে উলামা ব্যাখ্যা করেছেন। আর কতকগুলি হাসান এবং কতকগুলি যইফ বা দুর্বলও রয়েছে। কিন্তু এই দুর্বল হাদীসগুলিও সহীহ ও হাসান হাদীসগুলির কারণে মযবুত হয়ে যাচ্ছে। এরূপ যখন হলো তখন এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়ে গেল যে, এই হাদীসগুলি হুজ্জত ও দলীল হওয়ার যোগ্য। এখন বাকী থাকলো ইমাম সাহেবের এই কথাটি যে, আখেরাতে আমল ও পরীক্ষার জায়গা নয়। নিঃসন্দেহে এটা সঠিক কথা, কিন্তু এর দ্বারা এটার অস্বীকৃতি কি করে হয় যে, কিয়ামতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে জান্নাত ও জাহান্নামে প্রবেশের পূর্বে কোন হুকুম আহকাম প্রদান করা হবে না? শায়েখ আবুল হাসান আশআরী (রঃ) তো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মাযহাবের আকীদায় শিশুদের পরীক্ষাকে দাখিল করেছেন। উপরন্তু يَوْمَ يُكْشَفُ عَنْ سَاقٍ কুরআন কারীমের এই আয়াতটি এর স্পষ্ট দলীল যে, মুনাফিক ও মুমিনের মধ্যে প্রভেদ করার জন্যে পায়ের গোছা খুলে দেয়া হবে এবং সিজদার হুকুম হবে। সহীহ হাদীস সমূহে রয়েছে যে, মু'মিনরা তো সিজদা করে নিবে, কিন্তু মুনাফিকরা উল্টো মুখে পিঠের ভরে পড়ে যাবে।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে ঐ ব্যক্তির ঘটনাও রয়েছে যে ব্যক্তি সর্বশেষে জাহান্নাম থেকে বের হবে। সে আল্লাহ তাআলার সাথে ওয়াদা অঙ্গীকার করবে যে, সে একটি আবেদন ছাড়া তাঁর কাছে আর কোন আবেদন করবে না। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তার এ আবেদন পুরো করবেন। কিন্তু তখন সে তার কৃত অঙ্গীকার থেকে ফিরে যাবে এবং অন্য একটি আবেদন করে বসবে ইত্যাদি। পরিশেষে আল্লাহ তাআলা তাকে বলবেন। হে আদম। সন্তান! তুমি বড়ই অঙ্গীকার ভঙ্গকারী। আচ্ছা যাও, জান্নাতে প্রবেশ কর।”
তারপর ইমাম সাহেবের এ কথা বলা যে, তাদেরকে তাদের শক্তির বাইরের হুকুম অর্থাৎ জাহান্নামে লাফিয়ে পড়ার হুকুম কি করে হতে পারে? আল্লাহ তাআ’লা কাউকেও তার সাধ্যের অতিরিক্ত কষ্ট দেন না। তাঁর একথাটিও হাদীসের বিশুদ্ধতায় কোন বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। স্বয়ং ইমাম সাহেব এবং সমস্ত মুসলমান এটা স্বীকার করে যে, পুলসিরাত অতিক্রম করার হুকুম সবারই হবে যা জাহান্নামের পৃষ্ঠোপরি থাকবে। তা হবে তরবারীর চাইতেও তীক্ষ এবং চুলের চাইতেও সূক্ষ্ম। মু’মিন ওঁর উপর দিয়ে নিজেদের পুণ্যের পরিমান অনুপাতে পার হয়ে যাবে। কেউ বিদ্যুতের গতিতে পার হয়ে যাবে। কেউ পার হবে বাতাসের গতিতে, কেউ পার হবে ঘোড়ার গতিতে এবং কেউ কেউ উটের গতিতে পার হয়ে যাবে। আর কেউ কেউ পলাতকের মত, কেউ কেউ পদাতিকের মত, কেউ কেউ হাঁটু কাঁপাতে কাঁপাতে এবং কেউ কেউ কেটে কেটে জাহান্নামে পড়ে যাবে। সুতরাং সেখানে এটা যখন হবে তখন জাহান্নামে লাফিয়ে পড়ার হুকুম তো এর চেয়ে বড় কিছু নয়, বরং ওটাই এর চেয়ে বেশী বড় ও কঠিন। আরো শুনুন, হাদীসে আছে যে, দাজ্জালের সঙ্গে আগুন ও বাগান থাকবে। শারে’ আলাই হিসসালাম মুমিনদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, তারা যেটাকে আগুন দেখছে তার থেকে যেন পান করে। এটা তাদের জন্যে ঠাণ্ডা ও শান্তির জিনিস। সুতরাং এটা এই ঘটনার স্পষ্ট দৃষ্টান্ত। আরো দৃষ্টান্ত রয়েছে, যেমন বাণী ইসরাঈল যখন গো বৎসের পূজা করে তখন তাদের শাস্তি স্বরূপ আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দেন যে, তারা যেন পরস্পর একে অপরকে হত্যা করে। এক মেঘ খণ্ড এসে তাদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তারপর যখন তরবারী চালনা শুরু হলো তখন সকালেই মেঘ কেটে যাওয়ার পূর্বেই তাদের মধ্যে সত্তর হাজার মানুষ নিহত হয়ে যায়। পিতা পুত্রকে এবং পুত্র পিতাকে হত্যা করে ফেলে। ঐ হুকুম কি এই হুকুমের চেয়ে ছোট ছিল? ঐ আমল কি তাদের সাধ্যের অতিরিক্ত ছিল না? তাহলে তো তাদের সম্পর্কেও এটা বলে দেয়া উচিত ছিল যে, আল্লাহ তাআলা কাউকেও তার সহ্যের অতিরিক্ত কষ্ট দেন না?
এই সমুদয় বিতর্ক পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পর এখন জেনে রাখুন যে, মুশরিকদের বাল্যাবস্থায় মৃত শিশুদের সম্পর্কেও বহু উক্তি রয়েছে। একটি উক্তি এই যে, তারা সব জান্নাতী। তাঁদের দলীল মিরাজ সম্পকীয় এ হাদীসটি যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত ইবরাহীমের (আঃ) পার্শ্বে মুশরিক ও মুসলমানদের শিশুদেরকে দেখেছিলেন। তাঁদের আরো দলীল সনদের ঐ রিওয়াইয়াতটি যা পূর্বে গত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “শিশুরা জান্নাতে যাবে।” হাঁ, তবে পরীক্ষা হওয়ার যে হাদীসগুলি বর্ণিত আছে সেগুলো বিশিষ্ট। সুতরাং যাদের সম্পর্কে রাব্বল আলামীনের জানা আছে যে, তারা অনুগত ও বাধ্য, তাদের রূহ আলামে বারাখে হযরত ইবরাহীমের (আঃ) পার্শ্বে রয়েছে। আর সেখানে মুসলমানদের শিশুদের রূহগুলিও রয়েছে। পক্ষান্তরে যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা জানেন যে, তারা হক কবুলকারী নয় তাদের বিষয়টি আল্লাহ তাআলার উপর অর্পিত। তারা কিয়ামতের দিন জাহান্নামী হবে। যেমন পরীক্ষার হাদীসগুলি দ্বারা এটা প্রকাশিত। ইমাম আশআরী (রঃ) এটা আহলে সুন্নাত হতে বর্ণনা করেছেন। এখন কেউ তো বলেন যে, এরা স্বতন্ত্রভাবে জান্নাতী। আবার অন্য কেউ কেউ বলেন যে, এরা জান্নাতীদের খাদেম। যদিও আবু দাউদ তায়ালেসী (রঃ) এইরূপ বর্ণনা করেছেন, কিন্তু ওর সনদ দুর্বল। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী। দ্বিতীয় উক্তি এই যে, মুশরিকদের শিশুরাও তাদের বাপ-দাদাদের সাথে জাহান্নামে যাবে। যেমন মুসনাদ প্রভৃতি হাদীসে রয়েছে যে, তারা তাদের বাপদাদাদের অনুসারী। একথা শুনে হযরত আয়েশা (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “তারা কোন আমল করার সুযোগ পায় নাই তবুও কি?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “তারা কি আমল করতো তা আল্লাহ তাআলা ভালরূপেই জানেন।
হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহকে (সঃ) মুসলমানদের শিশুদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তরে বলেনঃ “তারা তাদের বাপ-দাদাদের সাথে থাকবে।” আমি জিজ্ঞেস করলামঃ মুশরিকদের হুকুম কি? জবাবে তিনি বলেনঃ “তারাও তাদের বাপ-দাদাদের সঙ্গে থাকবে।” আমি আবার প্রশ্ন করলামঃ তারা কোন আমল করে নাই তবুও? জবাবে তিনি বললেনঃ “সে কি আমল করতো তা আল্লাহ তাআলা ভালরূপেই জানেন।” (এ হাদীসটি সুনানে আবি দাউদে বর্ণিত হয়েছে)
মুসনাদের হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আয়েশাকে (রাঃ) বলেছিলেনঃ “তুমি যদি ইচ্ছা কর তবে আমি তোমাকে তাদের ক্রন্দন ও চীৎকার ধ্বনি শোনাতে পারি।”
ইমাম আহমদের (রঃ) পুত্র রিওয়াইয়াত করেছেন যে, হযরত খাদীজা’ (রাঃ) তাঁর ঐ দুই সন্তান সম্পর্কে রাসূলুল্লাহকে (সঃ) জিজ্ঞেস করেন যারা অজ্ঞতার যুগে মারা গিয়েছিল। তিনি উত্তরে বলেনঃ “তারা দুজন জাহান্নামী।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন দেখেন যে, একথাটি হযরত খাদীজা’র কাছে খুব কঠিন বোধ হয়েছে তখন তিনি তাকে বলেনঃ “তুমি যদি তাদের স্থান দেখতে পেতে তবে তুমি নিজেও তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে যেতে।”এরপর হযরত খাদীজা (রাঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ “যে শিশুগুলি আপনার ঔরষে জন্মগ্রহণ করেছিল (তাদের কি হবে)?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “জেনে রেখো যে, মু'মিন এবং তাদের শিশুরা জান্নাতী এবং মুশরিক ও তাদের সন্তানরা জাহান্নামী।” অতঃপর তিনি নিম্নের আয়াতটি পাঠ করেনঃ وَ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ اتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّیَّتُهُمْ بِاِیْمَانٍ اَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّیَّتَهُمْ অর্থাৎ “যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের সন্তানরা ঈমানে তাদের সাথে তাদের অনুসরণ করেছে, আমি তাদের সন্তানদেরকে তাদের সাথে মিলিত করবো।” (এ হাদীসটি গারীব বা দুর্বল। এর ইসনাদে মুহাম্মদ ইবনু উছমান নামক বর্ণনাকারীর অবস্থা অজানা রয়েছে এবং তাঁর শায়েখ যাযান হযরত আলীকে (রাঃ) এখানে পান নাই। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন)
সুনানে আবি দাউদে রয়েছে যে, জীবন্ত প্রোথিতকারী এবং যাকে জীবন্ত প্রোথিত করা হয়েছে উভয়েই জাহান্নামী।
সুনানে আবি দাউদে এই সনদটি হাসানরূপে বর্ণিত হয়েছে। হযরত সালমা ইবনু কায়েস আকাঈ (রাঃ) বলেনঃ “আমি আমার ভাইকে সাথে নিয়ে রাসূলুল্লাহর খিদমতে হাজির হলাম এবং বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদের মাতা অজ্ঞতার যুগে মারা গেছেন। তিনি আত্মীয়তার সম্পর্ক যুক্ত রাখতেন এবং অতিথিপরায়ণা ছিলেন। কিন্তু তিনি আমাদের একটা অপ্রাপ্ত বয়স্কা বোনকে জীবন্ত কবর দিয়েছেন (তার অবস্থা কি হবে?)” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “যে এইরূপ করেছে এবং যাকে এইরূপ করা হয়েছে তারা উভয়েই জাহান্নামী।” সে যদি ইসলাম পায় এবং তা কবুল করে নেয় তবে সেটা অন্য কথা।
তৃতীয় উক্তি এই যে, তাদের ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করা উচিত। এক তরফাভাবে তাদের সম্পর্কে কোন ফায়সালা দেয়া উচিত নয়। তাঁরা রাসূলুল্লাহর (সঃ) এই উক্তির উপর ভিত্তি করেই এ কথা বলেছেন যে, তাদের আমলের সঠিক ও পূর্ণ অবগতি আল্লাহ তাআলারই রয়েছে।
সহীহ বুখারীতে রয়েছে যে, যখন রাসূলুল্লাহকে (সঃ) মুশরিকদের সন্তানদের . ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলো তখন তিনি এই ভাষাতেই উত্তর দিয়েছিলেন। কেউ কেউ বলেন যে, তাদেরকে ‘আরাফ’ নামক স্থানে রাখা হবে। এই উক্তিরও ফল এটাই যে, তারা জান্নাতী। কেননা, আরাফ কোন বাস করার স্থান নয়। এখানে অবস্থানকারীরা শেষে বেহেশতেই যাবে। যেমন সরায়ে আ’রাফের তাফসীরে আমরা এটা বর্ণনা করেছি। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআ'লাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
এ সব মতভেদ তো ছিল মুশরিকদের সন্তানদের ব্যাপারে। কিন্তু মুমিনদের অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানদের বাপারে আলেমদের সর্বসম্মত মত এই যে, তারা জান্নাতী। যেমন ইমাম আহমদের (রঃ) উক্তি রয়েছে। আর এটা জনগণের মধ্যে প্রসিদ্ধ হয়েও রয়েছে। আর ইনশা আল্লাহ আমাদের এই আশাও রয়েছে। কিন্তু কতকগুলি আলেম হতে বর্ণিত আছে যে, তারা তাদের ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করে থাকেন এবং বলেনঃ ‘সবাই মহামহিমান্বিত আল্লাহর মর্জি ও ইচ্ছার অধীন। আহলে ফিকহ ও আহলে হাদীসের একটি দলও এদিকেই গিয়েছেন। মুআত্তায়ে ইমাম মালিকের اَبْوَابُ الْقَدْرِ এর হাদীসসমূহেও এ ধরনেরই কথা রয়েছে, তবে ইমাম মালিকের (রঃ) কোন ফায়সালা এতে নেই।
পর যুগীয় মনীষীদের কারো কারো উক্তি এই যে, মুসলমানদের শিশুরা জান্নাতী এবং মুশরিকদের শিশুরা আল্লাহ তাআলার ইচ্ছাধীন। ইবনু আবদিল বারর (রঃ) এটাকে এই ব্যাখ্যাতেই বর্ণনা করেছেন। কিন্তু কুরতুবী (রাঃ) এটাই বলেছেন। এসব ব্যাপারে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ।
এই ব্যাপারে ঐ সব গুরুজন একটি হাদীসও আনয়ন করেছেন যে, আনসারদের একটি শিশুর জানা যায়, রাসূলুল্লাহকে (সঃ) আহবান করা হলে হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ “এই শিশুটিকে মারহাবা! এতো বেহেশতের পাখী। না সে কোন খারাপ কাজ করেছে, না সেই সময় পেয়েছে। তার একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বলেনঃ “এটা ছাড়া অন্য কিছুও তো হতে পারে? হে আয়েশা (রাঃ) ! জেনে রেখো যে, আল্লাহ তাআলা জান্নাত ও জান্নাতীদেরকে নির্দিষ্ট করে রেখেছেন, অথচ তখন তারা তাদের পিতাদের পৃষ্ঠে ছিল। অনুরূপভাবে তিনি জাহান্নাম সৃষ্টি করেছেন এবং জাহান্নামে যারা দগ্ধিভূত হবে তাদেরকেও সৃষ্টি করেছেন, অথচ তারাও তখন তাদের পিতাদের পৃষ্ঠের মধ্যে ছিল।” এ হাদীসটি সহীহ মুসলিম ও সুনানে বর্ণিত হয়েছে। এই মাসআলাটি সহীহ দলীল ছাড়া সাব্যস্ত হতে পারে না এবং লোকেরা তাদের অজ্ঞতার কারণে প্রমাণ ছাড়াই এ সম্পর্কে উক্তি করতে শুরু করে দিয়েছে, এই জন্যে আলেমদের একটি দল এই বিষয়ে কোন উক্তি করাই অপছন্দ করেছেন। হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) , কাসিম ইবনু মুহাম্মদ ইবনু আবি বকর (রাঃ) এবং মুহাম্মদ ইবনু হানীফা (রাঃ) প্রভৃতি তো মিম্বরে উঠে ভাষণে বলেছিলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “এই উম্মতের কাজ-কর্ম সঠিক থাকবে, যে পর্যন্ত তারা শিশুদের সম্পর্কে ও তকদীর সম্পর্কে কোন মন্তব্য না করবে।” (এটা ইবনু হাব্বান (রঃ) বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন যে, এর দ্বারা মুশরিকদের শিশুদের সম্পর্কে কোন মন্তব্য না করা বুঝানো হয়েছে। অন্যান্য কিতাবে এই রিওয়াইয়াতটি হযরত আবদুল্লাহর (রাঃ) নিজের উক্তি দ্বারা মারফু’ রূপে বর্ণিত হয়েছে)