৭-১৫ নং আয়াতের তাফসীর:
পূর্বের আয়াতগুলোতে যাকারিয়া (عليه السلام) এর সন্তান লাভের দু‘আর কথা তুলে ধরা হয়েছে। অত্র আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা যাকারিয়া (عليه السلام)-এর দু‘আ কবূল করে সন্তান দিলেন এমনকি সন্তানের নামও রেখে দিলেন যে, তার নাম হবে ইয়াহইয়া। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَنَادَتْهُ الْمَلٰ۬ئِكَةُ وَهُوَ قَآئِمٌ يُّصَلِّيْ فِي الْمِحْرَابِ لا أَنَّ اللّٰهَ يُبَشِّرُكَ بِيَحْيٰي مُصَدِّقًاۭ بِكَلِمَةٍ مِّنَ اللّٰهِ وَسَيِّدًا وَّحَصُوْرًا وَّنَبِيًّا مِّنَ الصّٰلِحِيْن)
“অতঃপর ফেরেশতারা তাকে ডেকে বললেন: তখন তিনি মেহরাবে সালাতরত অবস্থায় ছিলেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে ইয়াহইয়ার সুসংবাদ দিচ্ছেন। তিনি হবেন আল্লাহর বাণীর সত্যায়নকারী, নেতা, প্রবৃত্তি দমনকারী এবং পুণ্যবান নাবীদের একজন।” (সূরা আলি-ইমরান ৩:৩৮-৩৯)
سَمِيًّا অর্থাৎ এ নামে পূর্বে আমি আর কারো নামকরণ করিনি। যাকারিয়া (عليه السلام) সুসংবাদ পেয়ে বললেন: হে আমার পালনকর্তা! কেমন করে আমার পুত্র হবে, অথচ আমার স্ত্রী বন্ধ্যা এবং আমি বার্ধক্যে উপনীত হয়ে গেছি। সূরা আলি ইমরানের ৪০ নং আয়াতও এ কথা বলা হয়েছে।
عَاقِرًا বলা হয় যে নারী বার্ধক্যের কারণে সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম, আবার ঐ মহিলাকেও বলা হয়, যে প্রথম থেকেই বন্ধ্যা। এখানে বার্ধক্যের কারণে যে বন্ধ্যা তা-ই উদ্দেশ্য।
যাকারিয়া (عليه السلام) এর প্রশ্নের জবাবে ফেরেশতা বললেন, এভাবেই হবে। তোমার প্রভু বলে দিয়েছেন যে, এটা আমার জন্য খুবই সহজ। আমি তো ইতোপূর্বে তোমাকে সৃষ্টি করেছি, যখন তুমি কিছুই ছিলে না। সুতরাং যে আল্লাহ তা‘আলা কিছু ছাড়াই মানুষ সৃষ্টি করতে পারেন তিনি বৃদ্ধ বয়সেও সন্তান দিতে পারবেন।
যাকারিয়া (عليه السلام) বললেন: হে আমার পালনকর্তা! আমাকে একটি নিদর্শন প্রদান করুন। আল্লাহ তা‘আলা বললেন, তোমার নিদর্শন হচ্ছে, তুমি সুস্থাবস্থায় একটানা তিনদিন কারো সাথে কথা বলতে পারবে না। সূরা আলি ইমরানে বলা হয়েছে, ইশারা করা ছাড়া কথা বলতে পারবে না। অতঃপর তিনি কক্ষ থেকে বের হয়ে সম্প্রদায়ের নিকট আসলেন এবং তাদেরকে ইঙ্গিতে বললেন, সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ পাঠ করার জন্য। سَوِيًّا অর্থ: পূর্ণ সুস্থ, অর্থাৎ কথা বলতে সক্ষম এমন সুস্থাবস্থায় কথা বলতে পারবে না।
যাকারিয়া (عليه السلام) এর দু‘আ অনুযায়ী যখন ছেলে ইয়াহইয়া (عليه السلام)-কে পেলেন আর ইয়াহইয়া (عليه السلام)-বুঝেন-শুনেন এমন বয়সে উপনীত হলেন তখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রতি ওয়াহী নাযিল করে বললেন, হে ইয়াহইয়া! দৃঢ়তার সাথে এ কিতাব ধারণ কর। (خُذِ الْكِتٰبَ بِقُوَّةٍ) অর্থাৎ তার ওপর আমল কর। কিতাব বলতে তাওরাতকে বা তাঁকে যে বিশেষ কিতাব দান করা হয়েছে তা বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার বিধি-বিধান সম্পর্কে প্রজ্ঞা ও পাণ্ডিত্য দান করেছেন। তখন তিনি ছোট বয়সের ছিলেন।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহইয়া (عليه السلام) এর বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন;
(১) শৈশবেই প্রজ্ঞা দান করা হয়েছে (২) তাঁকে নরম প্রকৃতি ও কোমলতা দান করেছেন, (৩) তিনি পূত-পবিত্র ছিলেন, (৪) তিনি অতীব তাক্বওয়াশীল, (৫) পিতা-মাতার প্রতি অনুগত এবং (৬) তিনি উদ্ধত ও অবাধ্য নন।
এছাড়াও সূরা আলি ইমরানে তাঁর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, (৭) তিনি সাক্ষ্য দিবেন আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশের সত্যতা সম্পর্কে, (৮) তিনি হবেন নেতা, (৯) তিনি নারীসঙ্গ মুক্ত হবেন, (১০) তিনি একজন সৎ কর্মশীল নাবী হবেন।
তাঁর উপরে শান্তি যেদিন তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন আর যেদিন তিনি মৃত্যুবরণ করবেন এবং যেদিন তাঁকে জীবিত অবস্থায় পুনরুত্থিত করা হবে।
মানুষের তিনটি সময় কঠিন ও ভয়াবহ (১) যখন সে মায়ের গর্ভ থেকে পৃথিবীতে আসে, (২) যখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, (৩) যখন কবর থেকে জীবিত করা হবে এবং নিজেকে কিয়ামতের দিন ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি দেখবে। এ তিন সময়ই তাঁর জন্য থাকবে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে শান্তি।
অনেকে এ আয়াত থেকে দলীল গ্রহণ করে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জন্মোৎসব বা ঈদে মীলাদুন্নাবী উদ্যাপন করে থাকে। তারা বলে: আল্লাহ তা‘আলা জন্মদিনের জন্য সালাম শব্দটি ব্যবহার করেছেন, তাই আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জন্মদিনে সালাম দেয়ার জন্য ঈদে মীলাদুন্নাবী পালন করে থাকি। তাদের এ দাবী ভিত্তিহীন। কারণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবদ্দশায় এরূপ কোনকিছুর প্রমাণ পাওয়া যায় না; এমনকি সাহাবী, তাবিঈদের যুগেও নয় যার অনুসরণ করা যায়। অতএব এগুলো স্পষ্ট বিদআত যা সর্বাবস্থায় বর্জনীয়। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে যাবতীয় বিদআতী কর্মকাণ্ড পরিহার করে কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ মোতাবেক আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন!
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মানুষের সকল অভাব পূরণ করে থাকেন একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
২. আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে অস্তিত্বহীনতা থেকে সৃষ্টি করেছেন।
৩. সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ পাঠ করতে হবে।
৪. আল্লাহ তা‘আলার প্রতি দৃঢ় আস্থা ও সৎ আমল করে আহ্বান করলে তিনি আহ্বানে সাড়া দেন।
৫. ঈদে মীলাদুন্নাবী পালন করা কোন নেকীর কাজ নয়, যদি তা হত তাহলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবীগণ তা পালন করতেন। সুতরাং তা বর্জণীয় এবং পালন করা বিদ‘আত।