১৬৫-১৬৭ নং আয়াতের তাফসীর
এই আয়াতসমূহে মুশরিকদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক অবস্থা বর্ণনা করা হচ্ছে। তারা আল্লাহ তা'আলার অংশীদার স্থাপন করে থাকে এবং অন্যদেরকে তার সদৃশ স্থির করে থাকে। অতঃপর তাদের সাথে এমন আন্তরিক ভালবাসা স্থাপন করে যেমন ভালবাসা আল্লাহ তা'আলার সাথে স্থাপন করা উচিত ছিল। অথচ তিনিই প্রকৃত উপাস্য এবং তিনি এক। তিনি অংশীদার হতে সম্পূর্ণ রূপে পবিত্র। সহীহ বুখারী ও মুসলিমের মধ্যে রয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ “আমি জিজ্ঞেস করি-হে আল্লাহর রাসূল! সবচেয়ে বড় পাপ কিতিনি বলেনঃ “আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে শিরক করা, অথচ সৃষ্টি তিনি একাই করেছেন। অতঃপর আস্লাহ বলেনঃ ‘আল্লাহ তা'আলার প্রতি মু'মিনদের প্রেম দৃঢ়তর হয়ে থাকে, অর্থাৎ তাদের অন্তর আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের বিশ্বাসে পরিপূর্ণ থাকে। মহান আল্লাহ ছাড়া আর কারও সাথে তাদের এরূপ ভালবাসাও নেই এবং তারা আর কারও কাছে প্রার্থনাও করে না। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও কাছে তারা মস্তক অবনত করে -তার সাথে অন্য কাউকে অংশীদারও করে না। অতঃপর আল্লাহ তা'আলা ঐসব লোককে শাস্তির সংবাদ দিচ্ছেন যারা শিবুকের মাধ্যমে তাদের আত্মার উপর অত্যাচার করতেছে। যদি তারা শাস্তি অবলোকন করতো তবে তাদের অবশ্যই বিশ্বাস হতো যে, মহা ক্ষমতাবান তো একমাত্র আল্লাহ তা'আলাই। সমস্ত জিনিস তার অধীনস্থ এবং তাঁরই আজ্ঞাধীন। তার শাস্তিও খুব কঠিন। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ “সেই দিন তার শাস্তির মত কেউ শাস্তিও দিতে পারে না এবং তাঁর পাকড়াও এর মত কেউ পাকড়াও করতে পারে না।
দ্বিতীয় ভাবার্থ এও হতে পারে যে, যদি ঐ দৃশ্য সম্বন্ধে তাদের জ্ঞান থাকতো তবে কখনও তারা ‘শিরক ও কুফর'কে আঁকড়ে থাকতো না। দুনিয়ায় যাদেরকে তারা তাদের নেতা মনে করে রেখেছিল, কিয়ামতের দিন ঐ নেতারা তাদের থেকে পৃথক হয়ে যাবে। ফেরেশতাগণ বলবেনঃ “হে আমাদের প্রভু! আমরা এদের প্রতি অসন্তুষ্ট। এরা আমাদের উপাসনা করতো না। হে আল্লাহ! আপনি পবিত্র এবং আপনিই আমাদের অভিভাবক। বরং এৱা জ্বিনদের উপাসনা করতো। এদের অধিকাংশই ওদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী ছিল। অনুরূপভাবে জ্বিনরাও তাদের প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করবে এবং পরিষ্কারভাবে তাদের শত্রু হয়ে যাবে এবং তাদের ইবাদতকে অস্বীকার করবে। কুরআন মাজীদের মধ্যে অন্য জায়গায় রয়েছেঃ سَیَكْفُرُوْنَ بِعِبَادَتِهِمْ وَ یَكُوْنُوْنَ عَلَیْهِمْ ضِدًّا
অর্থাৎ ‘অতিসত্ত্বরই তারা তাদের ইবাদতকে অস্বীকার করবে এবং তারা তাদের শক্ত হয়ে যাবে।' (১৯:৮২) হযরত ইবরাহীম (আঃ) কাফিরদের প্রতি যে উক্তি করেছিলেন কুরআন মাজীদে তা নকল করা হয়েছেঃ “তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে মূর্তির ভালবাসা তোমাদের অন্তরে স্থান দিয়েছে এবং তাদের পূজা অর্চনা শুরু করে দিয়েছো অথচ কিয়ামতের দিন তারা তোমাদের উপাসনাকে অস্বীকার করে বসবে এবং তোমরা একে অপরের প্রতি লা'নত বর্ষণ করবে। তোমাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম এবং তোমাদের কোন সাহায্যকারী হবে না। এভাবেই অন্য জায়গায় রয়েছেঃ ‘অত্যাচারিরা তাদের প্রভুর সামনে দণ্ডায়মান অবস্থায় তাদের পরিচালকদেরকে বলবে-তোমরা না হলে আমরা ঈমানদার হয়ে যেতাম। তারা তখন উত্তরে বলবে আমরা কি তোমাদেরকে আল্লাহর ইবাদত হতে বিরত রেখেছিলাম। প্রকৃত ব্যাপার তো এই যে, তোমরা নিজেরাই পাপী ছিলে। তারা বলবে-তোমাদের রাত দিনের প্রতারণা, তোমাদের কুফরীপূর্ণ নির্দেশাবলী এবং তোমাদের শিরকের শিক্ষা আমাদেরকে প্রতারিত করেছে। এখন তারা শাস্তি দেখার পরে সবাই ভিতরে ভিতরে লজ্জিত হবে এবং তাদের কৃতকর্মের ফল স্বরূপ তাদের গলদেশে গলাবন্ধ পরিয়ে দেয়া হবে। অন্য স্থানে রয়েছেঃ ‘সেই শয়তানও বলবে, “নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের সঙ্গে সত্য অঙ্গীকার করেছিলেন। আর আমি তোমাদের সাথে অঙ্গীকার করেছি অতঃপর অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছি, তোমাদের উপর আমার কোন প্রভাবই ছিল না, বরং আমি তোমাদেরকে আহ্বান করেছি আর তোমরা তাতে সাড়া দিয়েছো। সুতরাং তোমরা আমাকে তিরস্কার করো না, বরং নিজেদেরকে তিরস্কার কর; না আমি তোমাদের সাহায্যকারী হতে পারি, না তোমরা আমার সাহায্যকারী হতে পার; আমি নিজেও তোমাদের এ কাজে অসন্তুষ্ট যে, তোমরা ইতিপূর্বে আমাকে (আল্লাহ) অংশীদার সাব্যস্ত করতে; নিশ্চয়ই অত্যাচারিদের জন্যে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। তারপরে আল্লাহ তা'আলা বলেন যে, তারা শাস্তি দেখে নেবে এবং সমস্ত সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। পলায়নেরও কোন জায়গা থাকবে না এবং মুক্তিরও কোন পথ চোখে পড়বে না। বন্ধুত্ব কেটে যাবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন হবে। বিনা প্রমাণে যারা তাদের পরিচালকদের কথামত চলতো, তাদের প্রতি বিশ্বাস রাখতো এবং তাদের আনুগত্য স্বীকার করত, পূজা অর্চনা করতো, তারা যখন তাদের পরিচালক ও নেতাদেরকে দেখবে যে, তারা তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করেছে, তখন তারা অত্যন্ত দুঃখ ও নৈরাশ্যের সাথে বলবে-যদি আমরা পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারতাম তবে আমরাও ওদেরকে প্রত্যাখ্যান করতাম যেমন এরা আমাদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং আমরা এদের প্রতি কোন ক্ৰক্ষেপ করতাম না, এদের কথা মানতাম না এবং এদেরকে আল্লাহর অংশীদার সাব্যস্ত করতাম না। বরং খাটি অন্তরে এক আল্লাহর ইবাদত করতাম। অথচ প্রকৃতই যদি ফিরিয়ে দেয়া হয় তবুও তারা পূর্বে যা করেছিল তাই করবে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন لَوْ رُدُّوْا لَعَادُوْا لِمَا نُهُوْا عَنْهُ অর্থাৎ যদি তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হয় তবে অবশ্যই তারা ঐ কাজই করবে যা থেকে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে।' (৬:২৮) এজন্যেই বলা হয়েছে তাদের কৃতকর্মসমূহ আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে দুঃখজনকভাবে প্রদর্শন করবেন। অর্থাৎ তাদের ভাল কর্ম যা কিছু ছিল সেগুলোও নষ্ট হয়ে যাবে। আল্লাহ তা'আলা অন্যত্র বলেনঃ তাদের কৃতকর্মের অবস্থা ঐ ছাই এর মত যাঁকে ভীষণ ঝড়ের দিন বায়ু প্রবল বেগে উড়িয়ে নিয়ে যায়। অন্য স্থানে আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ যারা কাফির হয়েছে তাদের কার্যাবলী যেন মরুভূমির মরীচিকা-পিপাসার্ত লোক যাকে পানি বলে মনে করে, কিন্তু ওর নিকটে গিয়ে কিছুই পায় না। তারপরে আল্লাহ তাআলা বলেন যে, তারা জাহান্নামের অগ্নি হতে উদ্ধার পাবে না। বরং তথায় তারা চিরকাল অবস্থান করবে।