وَالْبُدْنَ جَعَلْنٰهَا لَكُمْ مِّنْ شَعَاۤىِٕرِ اللّٰهِ لَكُمْ فِيْهَا خَيْرٌۖ فَاذْكُرُوا اسْمَ اللّٰهِ عَلَيْهَا صَوَاۤفَّۚ فَاِذَا وَجَبَتْ جُنُوْبُهَا فَكُلُوْا مِنْهَا وَاَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَالْمُعْتَرَّۗ كَذٰلِكَ سَخَّرْنٰهَا لَكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ ( الحج: ٣٦ )
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
আর (কুরবানীর) উটগুলোকে আমি করেছি আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম। তাতে তোমাদের জন্য কল্যাণ আছে, কাজেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো অবস্থায় ওগুলোর উপর তোমরা আল্লাহর নাম উচ্চারণ কর। যখন তা পার্শ্বভরে পড়ে যায়, তখন তাথেকে খাও আর যারা (ভিক্ষে না ক’রে) পরিতৃপ্ত থাকে তাদেরকে আর যারা কাকুতি মিনতি ক’রে যাচ্ঞা করে তাদেরকেও খাওয়াও। এভাবে আমি ওগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছি যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।
English Sahih:
And the camels and cattle We have appointed for you as among the symbols [i.e., rites] of Allah; for you therein is good. So mention the name of Allah upon them when lined up [for sacrifice]; and when they are [lifeless] on their sides, then eat from them and feed the needy [who does not seek aid] and the beggar. Thus have We subjected them to you that you may be grateful.
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
আর (কুরবানীর) উটকে[১] করেছি আল্লাহর (দ্বীনের) প্রতীকসমূহের অন্যতম; তোমাদের জন্য তাতে মঙ্গল রয়েছে। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান অবস্থায় ওগুলির উপর (নহর করার সময়) তোমরা আল্লাহর নাম নাও।[২] অতঃপর যখন ওরা কাত হয়ে পড়ে যায়[৩] তখন তোমরা তা হতে আহার কর[৪] এবং আহার করাও ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্তকে ও যাঞ্চাকারী অভাবগ্রস্তকে।[৫] এইভাবে আমি ওদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছি; যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।
[১] بُدن শব্দটি بَدَنَة এর বহুবচন। এর অর্থ মোটা-তাজা দেহবিশিষ্ট পশু। কুরবানীর পশু সাধারণতঃ মোটা-তাজা হয় বলে তাকে بَدَنَة বলা হয়। ভাষাবিদগণ শুধু উটের জন্যই এ শব্দটিকে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু হাদীসের দৃষ্টিতে গরুর জন্যও بَدَنَة শব্দের ব্যবহার সঠিক। অর্থ এই যে, উট বা গরু যা কুরবানীর জন্য (মক্কায়) নিয়ে যাওয়া হয় তাও আল্লাহর দ্বীনের নিদর্শন ও প্রতীকসমূহের মধ্যে গণ্য। অর্থাৎ, তা আল্লাহর ঐ সকল নির্দেশের অন্তর্ভূত; যা মুসলিমদের জন্যই নিদৃষ্ট এবং তাঁদের বিশেষ চিহ্ন।
[২] صَوَافّ শব্দটি مَصفُوفَة এর অর্থে ব্যবহূত হয়েছে। অর্থাৎ, সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান অবস্থায়। উটকে এভাবেই দাঁড়ানো অবস্থায় নহর করা হয়। তার সামনের বাম পা বেঁধে দেওয়া হয়; ফলে তিন পা খোলা অবস্থায় খাড়া থাকে।
[৩] অর্থাৎ, যখন দেহ থেকে রক্ত বের হয়ে গিয়ে তা মাটিতে কাত হয়ে পড়ে যায় এবং প্রাণত্যাগ করে, তখন তার গোশত কাটতে শুরু করো। কারণ জীবন্ত পশুর গোশত কেটে খাওয়া নিষিদ্ধ। মহানবী (সাঃ) বলেন, "জীবিত অবস্থায় কোন পশুর শরীর হতে কেটে নেওয়া গোশত মৃতের ন্যায় (হারাম)।" (আবূ দাঊদঃ শিকার অধ্যায়, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)
[৪] কিছু উলামার নিকট এই আদেশের মান ওয়াজেব। অর্থাৎ, কুরবানীর গোশত খাওয়া কুরবানীকারীর জন্য জরুরী। তবে অধিকাংশ উলামাগণের নিকট উক্ত আদেশের মান মুস্তাহাব বা জায়েয। অর্থাৎ, কুরবানীকৃত পশুর গোশত খাওয়া উত্তম। অতএব কেউ যদি সম্পূর্ণ গোশ্ত্কে বিলি করে দেয় এবং কিছু মাত্রও না খায়, তাহলে তাতেও কোন দোষ নেই।
[৫] قَانِع এর অর্থ ভিক্ষুক। এর অন্য একটি অর্থ অল্পে তুষ্ট ব্যক্তি। অর্থাৎ, অভাবী কিন্তু ভিক্ষা করে না বা কারো কাছে কিছু চায় না। আর مُعتَرّ শব্দের অর্থ (যাঞ্চাকারী অভাবগ্রস্ত) কেউ কেউ করেছেন, বিনা যাঞ্চায় আগত ব্যক্তি। আর কেউ قَانِع এর অর্থ ভিক্ষুক আর مُعتَرّ এর অর্থ অতিথি করেছেন। যাই হোক, এই আয়াত দ্বারা দলীল নিয়ে বলা হয় যে, কুরবানীর গোশ্ত্কে তিন ভাগ করা উচিত; একভাগ নিজে খাওয়ার জন্য, দ্বিতীয় ভাগ অতিথি ও আত্মীয়-স্বজনদের খাওয়ার জন্য এবং তৃতীয় ভাগ ভিক্ষুক ও সমাজের অভাবগ্রস্তদের জন্য। এ কথার সমর্থনে এই হাদীসটি তুলে ধরা হয়, যাতে মহানবী (সাঃ) বলেছেন, "আমি তোমাদেরকে তিন দিনের বেশি কুরবানীর গোশত রাখতে নিষেধ করেছিলাম, এখন তোমাদেরকে অনুমতি দিচ্ছি তোমরা খাও, প্রয়োজন মত জমা রাখো।" অন্য একটি বর্ণনার শব্দাবলী এই, "খাও, সা'দক্বা কর ও জমা রাখো।" আর একটি বর্ণনায় এসেছে, "খাও, খাওয়াও ও সা'দক্বা কর।" (বুখারীঃ কুরবানী অধ্যায়, মুসলিম, সুনান) কেউ কেউ দু'ভাগ করার কথা বলেন, অর্ধেক নিজের জন্য ও বাকী অর্ধেক সা'দক্বার জন্য। এঁরা এর আগের (২২;২৮ নং) আয়াত {فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ} (অতঃপর তোমরা তা হতে আহার কর এবং দুঃস্থ, অভাবগ্রস্তকে আহার করাও) থেকে দলীল গ্রহণ করেন। কিন্তু সত্য কথা এই যে, কোন আয়াত বা হাদীস দ্বারা নিক্তি ধরে এ রকম দু'ভাগ বা তিনভাগ করার কথা বোঝা যায় না। বরং সাধারণভাবে তা খাওয়া ও খাওয়ানোর কথাই বলা হয়েছে। অতত্রব এই সাধারণ নির্দেশকে সাধারণ রাখাই উচিত এবং ভাগাভাগির কোন নিয়ম বেঁধে দেওয়া উচিত নয়। অবশ্য কুরবানীর চামড়ার ব্যাপারে সকলেই একমত যে, তা নিজে ব্যবহার কর কিংবা সা'দক্বা করে দাও, বিক্রি করার অনুমতি নেই; যেমন হাদীসে আছে। (আহমাদ ৪/১৫) তবে কিছু উলামা চামড়া বিক্রি করে তার মূল্য গরীবদের মাঝে বন্টন করার অনুমতি দিয়েছেন। (ইবনে কাসীর)
বিঃদ্রঃ- কুরআন কারীমে এখানে কুরবানীর বর্ণনা হজ্জের মাসআলার সঙ্গে আনুষঙ্গিকভাবে এসেছে। যার ফলে হাদীস অস্বীকারকারীরা এই প্রমাণ করতে চায় যে, কুরবানী শুধুমাত্র হাজীদের জন্য; অন্যান্য মুসলিমদের জন্য তা জরুরী নয়। কিন্তু এ কথা সত্য নয়। কারণ অন্য জায়গায় ব্যাপকভাবে কুরবানীর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যেমন {فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ} অর্থাৎ নিজ প্রভুর জন্য নামায পড় ও কুরবানী কর। (সূরা কাউসার) আর মহানবী (সাঃ) এই আয়াতের মর্মার্থ কার্যতঃ এভাবে ব্যক্ত করেছেন যে, মদীনার জীবনে প্রতি বছর ১০ই যিল-হজ্জ কুরবানী করেছেন এবং মুসলিমদেরকে কুরবানী করতে তাকীদ করেছেন। সেহেতু সাহাবা (রাঃ)গণও কুরবানী করেছেন। তাছাড়া মহানবী (সাঃ) যেখানে কুরবানী সম্পর্কে বেশ কিছু উপদেশ দিয়েছেন সেখানে তিনি একথাও বলেছেন যে, ১০ই যিলহজ্জ আমরা সর্বপ্রথম নামায পড়ব, তারপর কুরবানীর পশু যবেহ করব। আর যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের আগেই কুরবানী করল। সে গোশত খাওয়ার ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করল; তার কুরবানী হল না। (বুখারীঃ ঈদ অধ্যায়, মুসলিমঃ কুরবানী অধ্যায়) এখান থেকে পরিষ্কার যে কুরবানীর আদেশ প্রত্যেক মুসলিমের জন্য; সে যেখানেই থাক। কারণ হাজীগণ তো ঈদের নামাযই পড়েন না। অতএব এখান থেকেও স্পষ্ট হয় যে, এ নির্দেশ হাজী ছাড়া অন্যদের জন্য। তবে কুরবানী করা ওয়াজেব নয়; সুন্নাতে মুআক্কাদাহ্। ঠিক অনুরূপ লোক দেখানোর জন্য বেশ কয়েকটি কুরবানী করাও সুন্নাহর পরিপন্থী। যেহেতু হাদীসানুসারে একটি পরিবারের সকলের তরফ হতে কেবল একটি পশুই যথেষ্ট। সাহাবাদের আমলও অনুরূপ ছিল। (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)