৩৮-৪১ নং আয়াতের তাফসীর:
হযরত যাকারিয়া (আঃ) দেখেন যে, আল্লাহ তা'আলা হযরত মারইয়াম (আঃ)-কে অসময়ের ফল দান করছেন। শীতকালে গ্রীষ্মকালের ফল এবং গ্রীষ্মকালে শীতকালের ফল তাঁর নিকট বিদ্যমান থাকছে। সুতরাং তিনিও স্বীয় বার্ধক্য ও স্বীয় সহধর্মিণীর বন্ধ্যাত্ব জানা সত্ত্বেও আল্লাহ তা'আলার নিকট অসময়ে ফল অর্থাৎ সুসন্তান লাভের প্রার্থনা জানাতে থাকেন। আর যেহেতু এটা বাহ্যতঃ অসম্ভব জিনিস ছিল, তাই তিনি অতি সন্তর্পণে এ প্রার্থনা জানান। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ ‘নেদায়ান খাফীয়া অর্থাৎ ‘গোপন প্রার্থনা।' তিনি তাঁর ইবাদতখানাতেই ছিলেন, এমন সময় ফেরেশতাগণ তাঁকে ডাক দিয়ে বলেনঃ আপনার একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করবে যার নাম ইয়াহইয়া রাখতে হবে।' সাথে সাথে তারা একথাও বলে দেনঃ ‘এ সুসংবাদ আমাদের পক্ষ থেকে নয়, বরং স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকে। ইয়াহইয়া নাম রাখার কারণ এই যে, তাঁর জীবন হবে ঈমানের সাথে। তিনি আল্লাহর কালেমা অর্থাৎ হযরত ঈসা ইবনে মারইয়াম (আঃ)-এর সত্যতা প্রকাশ করবেন। হযরত রাবী' ইবনে আনাস (রাঃ) বলেনঃ “হযরত ঈসা (আঃ)-এর নবুওয়াতের প্রথম স্বীকারকারীও হচ্ছেন হযরত ইয়াহইয়া (আঃ)'। হযরত কাতাদা (রঃ)-এর উক্তি এই যে, হযরত ইয়াহইয়া (আঃ) ঠিক হযরত ঈসা (আঃ)-এর পথের উপর ছিলেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এ দু’জন পরস্পর খালাতো ভাই ছিলেন। হযরত ইয়াহইয়া (আঃ)-এর মা প্রায়ই হযরত মারইয়াম (আঃ)-কে বলতেনঃ ‘আমি আমার গর্ভের জিনিসকে দেখতে পাচ্ছি যে, সে তোমার গর্ভের জিনিসকে সিজদা করছে। এটা ছিল হযরত ইয়াহইয়া (আঃ)-এর সত্যতা প্রকাশ তার দুনিয়ায় আগমনের পূর্বেই। সর্বপ্রথম তিনিই হযরত ঈসা (আঃ) -এর সত্যতা অবগত হয়েছিলেন। তিনি বয়সে হযরত ঈসা (আঃ) অপেক্ষা বড় ছিলেন। سَيِّد শব্দের অর্থ হচ্ছে ধৈর্যশীল, বিদ্যা ও ইবাদতে অগ্রবর্তী, মুত্তাকী, ধর্ম শাস্ত্রবিদ, চরিত্রে ও ধর্মে সর্বাপেক্ষা উত্তম, ক্রোধকে দমনকারী এবং ভদ্র। حَصُوْر শব্দের অর্থ হচ্ছে যে স্ত্রীলোকদের নিকট আসতে পারে না, যার সন্তানাদি হয় না এবং যার মধ্যে কোন কামভাব থাকে না। এ অর্থের একটি মারফু হাদীসও মুসনাদ-ই-ইবনে আবি হাতিমের মধ্যে রয়েছে। তা এই যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ শব্দটি পাঠ করতঃ ভূমি হতে কিছু উঠিয়ে নিয়ে বলেন, তাঁর অঙ্গ ছিল এরূপ। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ) বলেন, সমস্ত সৃষ্টজীবের মধ্যে শুধুমাত্র ইয়াহইয়া (আঃ) আল্লাহ তাআলার সাথে নিস্পাপরূপে সাক্ষাত করবেন। অতঃপর তিনি মাটি হতে কিছু উঠিয়ে নিয়ে বলেন, যার অঙ্গ এরূপ হয় তাকে حَصُوْر বলে।' হযরত ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আল কাত্তান (রঃ) অঙ্গুলি দ্বারা ইঙ্গিত করেন। উপরে বর্ণিত মারফু বর্ণনা অপেক্ষা এ মাওকুফ বর্ণনাটি সনদ হিসেবে অধিকতর সঠিক। মার' বর্ণনায় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) কাপড়ের ঝালরের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, এরূপ ছিল। অন্য বর্ণনায় রয়েছে যে, তিনি মাটি হতে একটা খড়কুটা উঠিয়ে নিয়ে ওর দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, তার অঙ্গ ছিল এই খড়কুটার মত।
এরপর হযরত যাকারিয়া (আঃ)-কে দ্বিতীয় শুভ সংবাদ দেয়া হচ্ছে যে, তাঁর পুত্র নবী হবেন। এ সুসংবাদ পূর্বের সুসংবাদ হতেও অগ্রগণ্য। এ সুসংবাদ প্রাপ্তির পর হযরত যাকারিয়া (আঃ)-এর ধারণা হয় যে, এর বাহ্যিক কারণগুলো তো অসম্ভব, তাই তিনি আল্লাহ তাআলার নিকট আরয করেন, “হে আমার প্রভু! আমি তো বার্ধক্যে পদার্পণ করেছি এবং আমার স্ত্রী বন্ধ্যা, কাজেই আমার সন্তান লাভ কিরূপে সম্ভব? ফেরেশতাগণ তৎক্ষণাৎ উত্তর দেন, আল্লাহর নির্দেশই সব চেয়ে বড়। তাঁর নিকট কোনকিছু অসম্ভবও নয় এবং কঠিনও নয়। তিনি কোন কাজে অসমর্থ নন। তিনি যেভাবেই ইচ্ছে করেন সৃষ্টি করে থাকেন। তখন হযরত যাকারিয়া (আঃ) আল্লাহ তা'আলার নিদর্শন যাজ্ঞা করলে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বলা হয়ঃ নিদর্শন এই যে, তুমি তিন দিন পর্যন্ত লোকের সাথে কথা বলতে পারবে না। তুমি সুস্থ সবল থাকবে বটে কিন্তু মুখ দিয়ে কথা বের হবে না। শুধুমাত্র ইশারা-ইঙ্গিতে কাজ চালাতে হবে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছে ثَلٰثَ لَيَالٍ سَوِيًّا অর্থাৎ ‘সুস্থতার সাথে তিন রাত'। (১৯:১০) এরপর বলা হচ্ছে- এ অবস্থায় খুব বেশী আল্লাহ তা'আলার যিক্রি করা এবং তার শ্রেষ্ঠত্ব ও পবিত্রতা বর্ণনা করা তোমার উচিত। সকাল-সন্ধ্যায় ঐ কাজেই লেগে থাকবে। এর দ্বিতীয় অংশ এবং পূর্ণ বর্ণনা সূরা-ই-মারইয়ামের মধ্যে বিস্তারিতভাবে আসবে ইনশাআল্লাহ।