৭৯-৮০ নং আয়াতের তাফসীর:
রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট যখন ইয়াহূদী ও নাজরানের খ্রীষ্টানগণ একত্রিত হয় এবং তিনি তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের প্রতি আহ্বান জানান তখন আবু রাফি’ ফারাযী বলেঃ আপনি চান যে, খ্রীষ্টানেরা যেমন হযরত ঈসা ইবনে মারইয়াম (আঃ)-এর ইবাদত করে তদ্রুপ আমরাও আপনার ইবাদত করি? তখন নাজরানী খ্রীষ্টানদের মধ্যে আঈস' নামক এক ব্যক্তিও এ কথাই বলেঃ ‘আপনি কি এটাই চান? এই কি আপনার দাওয়াত? তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আমি এটা হতে আল্লাহ তা'আলার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি। না নিজে আমি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করি, না অন্য কাউকে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত করার শিক্ষা দেই। আমার প্রেরিতত্ত্বের উদ্দেশ্যও এটা নয়। এবং আল্লাহ তা'আলা আমাকে এর নির্দেশও দেননি। তখন এ আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয় এবং বলা হয়-কোন মানুষের জন্যে বাঞ্ছনীয় নয় যে, ধর্মীয় গ্রন্থ, নবুওয়াত এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান লাভের পর সে মানুষকে স্বীয় ইবাদতের জন্যে আহ্বান করে। এত বড় বড় নবী যাদেরকে এত বেশী শ্রেষ্ঠত্ব ও সম্মান দান করা হয়েছে। তাদেরকেই যখন মানুষের ইবাদত গ্রহণের মর্যাদা দেয়া হয়নি। তখন অন্য লোক কোন মুখে মানুষকে নিজের ইবাদতের জন্যে আহ্বান করতে পারে? ইমাম হাসান বসরী (রঃ) বলেনঃ একজন সাধারণ মুমিন দ্বারাও এটা হতে পারে না যে, সে মানুষকে স্বীয় ইবাদতের দিকে আহ্বান করে। এখানে এটা বলার কারণ এই যে, ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টানেরা পরস্পরের মধ্যেই একে অপরের ইবাদত করতো। পবিত্র কুরআনই তার সাক্ষী। ইরশাদ হচ্ছেঃ اِتَّخَذُوْۤا اَحْبَارَهُمْ وَ رُهْبَانَهُمْ اَرْبَابًا مِّنْ دُوْنِ اللّٰهِ অর্থাৎ তারা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের আলেমদেরকে ও দরবেশদেরকে নিজেদের প্রভু বানিয়ে নিয়েছে। (৯:৩১) মুসনাদ-ই-আহমাদ ও জামেউত্ তিরমিযীর এ হাদীসও আসছে যে, হযরত আদী ইবনে হাতিম (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে আরয করেন যে, তারা তো তাদের পূজো করতো না। তখন তিনি বলেনঃ “কেন নয়? তারা তাদের উপর হারামকে হালাল করতো এবং হালালকে হারাম করতো এবং ওরা ওদের কথা মেনে চলতো। এটাই ছিল তাদের ইবাদত।' সুতরাং মূর্খ দরবেশ এবং নির্বোধ আলেমরা এ ধমকের অন্তর্ভুক্ত। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এবং তার অনুসারী আলেমগণ এটা হতে সম্পূর্ণ পৃথক। কেননা, তারা তো শুধুমাত্র আল্লাহ তা'আলার আদেশ ও নিষেধ এবং তার রাসূল (সঃ)-এর কথাই প্রচার করে থাকেন এবং এসব কাজ হতে মানুষকে বিরত রাখেন যেসব কাজ হতে নবীগণ (আঃ) বিরত রাখতেন। নবীগণততা হচ্ছেন সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টের মাঝে দূত স্বরূপ। তারা প্রেরিতত্বের কার্যাবলী পালন করেন এবং আল্লাহ তাআলার আমানত অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তাঁর বান্দাদের নিকট পৌছিয়ে থাকেন। রাসূলদের সুপথ প্রদর্শন তো হচ্ছে মানুষকে প্রভুর ইবাদতকারী বানিয়ে দেয়া। ওর মাধ্যমে তারা জ্ঞানী, বুদ্ধিমান, মুত্তাকী এবং পুণ্যবান হয়ে যায়।
হযরত যহহাক (রঃ) বলেন, কুরআন কারীম শিক্ষাকারীদের উপর এ দাবী রয়েছে যে, তারা যেন বিবেচক হয়। তাআলামুনা এবং তুআলেমুনা এ দুটো পঠনই রয়েছে। প্রথমটির অর্থ হচ্ছে অনুধাবন করা এবং দ্বিতীয়টির অর্থ হচ্ছে শিক্ষা দান করা। تَدْرُسُوْنَ শব্দের অর্থ হচ্ছে শব্দসমূহ মুখস্থ করা।
অতঃপর ইরশাদ হচ্ছেঃ সে এই নির্দেশ দেয় না যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত কর, সে আল্লাহ তা'আলার প্রেরিত রাসূলই হোক বা তার নৈকট্য লাভকারী ফেরেশতাই হোক। এ কথা ঐ ব্যক্তিই বলতে পারে যে আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদতের দিকে আহবান করে। আর যে ব্যক্তি এ কাজ করে সে কুফরী করে এবং কুফরী করা নবীদের (আঃ) কাজ নয়। তাদের কাজ তো হচ্ছে ঈমান, আর ঈমান হচ্ছে একক আল্লাহর ইবাদত করার নাম। নবীদের কণ্ঠে এ শব্দই উচ্চারিত হয়। যেমন স্বয়ং কুরআন মাজীদ ঘোষণা করেঃ وَ مَاۤ اَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَّسُوْلٍ اِلَّا نُوْحِیْۤ اِلَیْهِ اَنَّهٗ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّاۤ اَنَا فَاعْبُدُوْنِ অর্থাৎ তোমার পূর্বেও আমি যত রাসূল পাঠিয়েছিলাম সবারই উপরেই এ অহী করেছিলাম যে, আমি ছাড়া কেউ মা'বুদ নেই, সুতরাং তোমরা আমরাই ইবাদত কর। (২১:২৫) অন্য জায়গায় ঘোষণা করা হয়েছেঃ وَ لَقَدْ بَعَثْنَا فِیْ كُلِّ اُمَّةٍ رَّسُوْلًا اَنِ اعْبُدُوا اللّٰهَ وَ اجْتَنِبُوا الطَّاغُوْتَ অর্থাৎ আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে রাসূল পাঠিয়েছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত হতে বিরত থাক। (১৬:৩৬), অন্য স্থানে ইরশাদ হচ্ছেঃ “তোমার পূর্বেকার সমস্ত নবী (আঃ)-কে জিজ্ঞেস কর যে, আমি কি আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য মাবুদ নির্ধারিত করেছি যাদের তারা ইবাদত করবে?' ফেরেশতাদের পক্ষ হতে আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিচ্ছেনঃ وَ مَنْ یَّقُلْ مِنْهُمْ اِنِّیْۤ اِلٰهٌ مِّنْ دُوْنِهٖ فَذٰلِكَ نَجْزِیْهِ جَهَنَّمَ كَذٰلِكَ نَجْزِی الظّٰلِمِیْنَ অর্থাৎ তাদের মধ্যে যে বলে- আল্লাহকে বাদ দিয়ে আমিই পূজনীয় আমি তাকে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করাবো এবং এভাবেই আমি অত্যাচারীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। (২১:২৯)