১৫৩-১৫৪ নং আয়াতের তাফসীর:
ইয়াহূদীরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলেছিল- হযরত মূসা (আঃ) যেমন তাওরাত একই সাথে লিখিত অবস্থায় আল্লাহ তা'আলার নিকট হতে এনেছিলেন, দ্রুপ আপনিও পূর্ণভাবে লিখিত কোন আসমানী কিতাব আনয়ন করুন। এও বর্ণিত আছে যে, তারা বলেছিল-আপনি আল্লাহ তা'আলার নিকট হতে আমাদের নামে এমন পত্র আনয়ন করুন যাতে আপনাকে নবীরূপে মেনে নেয়ার নির্দেশ থাকে। এরূপ প্রশ্ন তারা বিদ্রুপ, অবাধ্যতা এবং কুফরীর উদ্দেশ্যেই করেছিল। যেমন মক্কাবাসীও তাকে অনুরূপ এক প্রশ্ন করেছিল যা সূরা-ই-সুবহানে উল্লিখিত আছে। তারা বলেছিল-“যে পর্যন্ত আরব ভূমির উপর আপনি নদী প্রবাহিত করে তাকে সবুজ শ্যামল প্রান্তরে পরিণত না করবেন সে পর্যন্ত আমরা আপনার উপর বিশ্বাস স্থাপন করবো না।
সুতরাং আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ)-কে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন-তাদের এ অবাধ্যতা এবং বাজে প্রশ্নের কারণে আপনি মোটেই দুঃখিত হবেন না। তাদের এটা পুরাতন অভ্যাস। তারা হযরত মূসা (আঃ)-কে এর চেয়েও জঘন্যতর প্রশ্ন করেছিল। তারা তাকে বলেছিল-আল্লাহকে প্রকাশ্যভাবে প্রদর্শন কর। এ অহংকার, অবাধ্যতা এবং বাজে প্রশ্নের প্রতিফলও তাদেরকে ভোগ করতে হয়েছে। অর্থাৎ আকাশের বিদ্যুৎ তাদের উপর পতিত হয়েছিল। যেমন সূরা-ই-বাকারায় বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। তথায় আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ وَ اِذْ قُلْتُمْ یٰمُوْسٰى لَنْ نُّؤْمِنَ لَكَ حَتّٰى نَرَى اللّٰهَ جَهْرَةً فَاَخَذَتْكُمُ الصّٰعِقَةُ وَ اَنْتُمْ تَنْظُرُوْنَ ـ ثُمَّ بَعَثْنٰكُمْ مِّنْۢ بَعْدِ مَوْتِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ অর্থাৎ “এবং যখন তোমরা বলেছিলে-হে মূসা, আমরা আল্লাহকে প্রকাশ্যভাবে দর্শন না করা পর্যন্ত তোমাকে বিশ্বাস করবো না। তখন বিদ্যুৎ তোমাদেরকে আক্রমণ করেছিল ও তোমরা তা প্রত্যক্ষ করেছিলে। তৎপর তোমাদের মৃত্যুর পর আমি তোমাদেরকে সঞ্জীবিত করেছিলাম-যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।” (২:৫৫-৫৬)
অতঃপর আল্লাহ তা'আলা বলেন-‘বড় বড় নিদর্শনাবলী প্রত্যক্ষ করার পরেও তারা গো বৎসের পূজো আরম্ভ করে দেয়। মিসরে তাদের শত্রু ফিরআউনের হযরত মূসা (আঃ)-এর মোকাবিলায় ডুবে মরা, তার সমস্ত সৈন্যের দুর্ভাগ্যের মৃত্যুবরণ করা, তাদের সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়ে সমুদ্র অতিক্রম করে যাওয়া, এ সবগুলোই তাদের চোখের সামনে সংঘটিত হয়েছে। তথাপি সেখান হতে কিছু দূর গিয়েই তারা মূর্তি পূজকদেরকে মূর্তিপূজো করতে দেখে স্বীয় নবী (আঃ)-কে বলে-আমাদের জন্যও এরূপ একটি মা’রূদ বানিয়ে দাও।' এর পূর্ণ বিবরণ সূরা-ই-আরাফ এবং সূরা-ই-ত্বাহার মধ্যেও রয়েছে।
অতঃপর হযরত মূসা (আঃ) আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করেন এবং তাদের তাওবা কবূল হওয়ার পন্থা এই বলে দেয়া হয় যে, যারা গো-বৎসের পূজো করেনি তারা পূজোকারীদেরকে হত্যা করবে। যখন হত্যাকার্য আরম্ভ হয়ে যায় তখন আল্লাহ পাক তাদের তাওবা কবুল করলেন এবং মৃতদেরকেও জীবিত করে দেন। তাই আল্লাহ তা'আলা এখানে বলেন-ওটাকেও আমি ক্ষমা করে দিয়েছি এবং এ মহা পাপকেও আমি মাফ করেছি। আর হযরত মূসা (আঃ)-কে প্রকাশ্য প্রভাব প্রদান করেছি।
যখন তারা তাওরাতের নির্দেশাবলী মান্য করতে অস্বীকার করে এবং হযরত মূসা (আঃ)-এর আনুগত্য স্বীকারে অসম্মত হয় তখন আল্লাহ তা'আলা তাদের মাথার উপর তুর পাহাড়কে সমুচ্চ করেন এবং তাদেরকে বলেন-“তোমরা এখন আমার আহকাম মানবে কি-না বল? নতুবা এ পর্বতকে আমি তোমাদের উপর নিক্ষেপ করবো। তখন তারা সবাই সিজদায় পড়ে গিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করে এবং নির্দেশাবলী মেনে নিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়। তাদের অন্তরে এত ভয় হয়েছিল যে, সিজদার মধ্যেও তারা আড় চোখে উপরের দিকে দেখে যে, না জানি পর্বত তাদের উপর পড়ে যায় এবং তারা মৃত্যু মুখে পতিত হয়ে যায়। অতঃপর পর্বত সরিয়ে দেয়া হয়।
এরপর তাদের অন্য অবাধ্যতার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, তারা কথা ও কাজ দু'টোই পরিবর্তন করেছিল। তাদেরকে বলা হয়েছিল-“তোমরা সিজদা করতে করতে বায়তুল মুকাদ্দাসের দরজায় প্রবেশ কর এবং حِطَّة বল।' অর্থাৎ তোমরা বল হে আল্লাহ! আপনি আমাদের পাপ মার্জনা করুন। আমরা আপনার পথে জিহাদ করা হতে বিরত রয়েছি, যার শাস্তি স্বরূপ আমরা ‘তিহ’ প্রান্তরে হতবুদ্ধি হয়ে চল্লিশ বছর পর্যন্ত ঘুরে বেরিয়েছি। কিন্তু এখানেও তাদের হঠকারিতা প্রকাশ পেয়েছে। তারা হাঁটুর ভরে চলতে চলতে বায়তুল মুকাদ্দাসের দরজায় পৌছে এবং حِنْطَةٌ فِىْ شَعْرَةٍ বলে। অর্থাৎ আমাদেরকে চুলের মধ্যে গম দান। করুন। তাদের আরও দুষ্টামি এই যে, শনিবারের মর্যাদা রক্ষার জন্যে তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ওর বিরুদ্ধাচরণেও তারা প্রস্তুত হয়ে যায় এবং কৌশল করে পাপকার্যে লিপ্ত হয়ে পড়ে। যেমন সূরা-ই-আ'রাফের وَ سْـئَـلْهُمْ عَنِ الْقَرْیَةِ الَّتِیْ كَانَتْ حَاضِرَةَ الْبَحْرِ (৭:১৬৩) -এ আয়াতের তাফসীরে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে।
একটি হাদীসেও রয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা ইয়াহূদীদের নিকট বিশেষ করে শনিবারের মর্যাদা রক্ষার উপর অঙ্গীকার নিয়েছিলেন। এ পূর্ণ হাদীসটি সূরা-ই-সুবহানের وَ لَقَدْ اٰتَیْنَا مُوْسٰى تِسْعَ اٰیٰتٍۭ بَیِّنٰتٍ (১৭:১০১)-এ আয়াতের তাফসীরে ইনশাআল্লাহ আসবে।