আন নিসা আয়াত ৫২
اُولٰۤىِٕكَ الَّذِيْنَ لَعَنَهُمُ اللّٰهُ ۗوَمَنْ يَّلْعَنِ اللّٰهُ فَلَنْ تَجِدَ لَهٗ نَصِيْرًا ( النساء: ٥٢ )
Ulaaa'ikal lazeena la'ana humul laahu wa mai yal'anil laahu falan tajida lahoo naseeraa (an-Nisāʾ ৪:৫২)
English Sahih:
Those are the ones whom Allah has cursed; and he whom Allah curses – never will you find for him a helper. (An-Nisa [4] : 52)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
এরা সেই লোক, যাদেরকে আল্লাহ অভিশাপ দিয়েছেন এবং যাকে আল্লাহ অভিশাপ দেন, তুমি কক্ষনো তার সাহায্যকারী পাবে না। (আন নিসা [৪] : ৫২)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
এরাই তো তারা, যাদেরকে আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন। আর আল্লাহ যাকে অভিসম্পাত করেন, তুমি কখনো তার জন্য কোন সাহায্যকারী পাবে না।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
এরাই তারা, যাদেরকে আল্লাহ লা’নত করেছেন [১] এবং আল্লাহ যাকে লা’নত করেন আপনি কখনো তার কোন সাহায্যকারী পাবেন না [২]।
[১] আল্লাহর অভিসম্পাত দুনিয়া ও আখেরাতের অপমানের কারণ। লা’নত ও অভিসম্পাত এর অর্থ হল, আল্লাহর রহমত ও করুণা থেকে দূরে সরে পড়া- চরম অপমান, অপদস্থতা। যার উপর আল্লাহর লা’নত পতিত হয় সে কখনো আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে না। তাদের সম্পর্কে অতি কঠিন ভর্ৎসনার কথা বলা হয়েছে। অন্যত্র বলা হয়েছে, “যাদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত হয়েছে, তাদের যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই নিহত অথবা ধৃত হবে”। [সূরা আল-আহযাব; ৬১] এটা তাদের পার্থিব অপমান। আখেরাতে তাদের অপমান এর চেয়েও কঠিন হবে।
[২] এ আয়াতের দ্বারা বোঝা যায় যে, যার উপর আল্লাহর লা’নত বর্ষিত হয়, তার কোন সাহায্যকারী থাকে না। এখন চিন্তা করার বিষয় এই যে, আল্লাহর লানতের যোগ্য কারা? এক হাদীসে আছে যে, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদ গ্রহীতা এবং সুদ দাতা, সুদ সংক্রান্ত দলীল সম্পাদনকারী এবং সুদের লেনদেনের সাক্ষী সবার প্রতিই অভিসম্পাত করেছেন। এদের সবাই পাপের ক্ষেত্রে সমান’। [মুসলিমঃ ১৫৯৮]
অন্য এক হাদীসে মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে লোক লুত ‘আলাইহিস্ সালামের সম্প্রদায়ের অনুরূপ কর্মে লিপ্ত হবে সে অভিশপ্ত হবে।’ [মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ৪/৩৯৬]
অতঃপর তিনি বলেছেন, “আল্লাহ্ তাআলা চোরদের প্রতিও অভিসম্পাত করেন। যে ডিম কিংবা রশির মত সাধারণ বস্তুও চুরি থেকে বিরত থাকে না, তারও হাত কাটা হয়। [বুখারীঃ ৬৪০১]
আরেক হাদীসে বলা হয়েছে, সুদ গ্রহীতা ও দাতার উপর আল্লাহ্ তা’আলার লা’নত এবং সে সমস্ত নারীর উপর যারা নিজেদের শরীর কেটে উল্কি আকে, যে অন্যের শরীর কেটেও উন্ধি একে দেয়, তেমনিভাবে চিত্রকারের উপরও আল্লাহর লা’নত। [বুখারীঃ ১৯৮০]
অপর এক হাদীসে মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ তা’আলা লা’নত করেন মদ্যপায়ীর প্রতি, মদ যে ব্যক্তি পান করায় তার প্রতি, তার বিক্রেতা ও ক্রেতার প্রতি, যে মদের নির্যাস বের করে তার প্রতি এবং যারা মদ্য বহন করে তাদের সবার প্রতি। [মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ২/৩৭]
3 Tafsir Bayaan Foundation
এরাই তারা যাদেরকে আল্লাহ লা‘নত করেছেন। আর আল্লাহ যাকে লা‘নত করেন তুমি কখনো তার কোন সাহায্যকারী পাবে না।
4 Muhiuddin Khan
এরা হলো সে সমস্ত লোক, যাদের উপর লা’নত করেছেন আল্লাহ তা’আলা স্বয়ং। বস্তুতঃ আল্লাহ যার উপর লা’নত করেন তুমি তার কোন সাহায্যকারী খুঁজে পাবে না।
5 Zohurul Hoque
এরাই সেইসব যাদের আল্লাহ্ ধিক্কার দিয়েছেন। আর যাকে আল্লাহ্ বঞ্চিত করেন তার জন্য তুমি কোনো সাহায্যকারী পাবে না।
6 Mufti Taqi Usmani
এরাই তারা, যাদের প্রতি আল্লাহ লানত করেছেন। আল্লাহ যার প্রতি লানত করেন, তুমি তার কোন সাহায্যকারী পাবে না।
7 Mujibur Rahman
এদেরই প্রতি আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন; এবং আল্লাহ যাকে অভিসম্পাত করেন, তুমি তার জন্য কোনই সাহায্যকারী খুঁজে পাবেনা।
8 Tafsir Fathul Mazid
৪৯-৫২ নং আয়াতের তাফসীর:
এ বিষয়ে সকল মুফাসসিরে কিরাম একমত যে, এ আয়াত ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানদের ব্যাপারে নাযিল হয়। কিন্তু এখানে “নিজেদেরকে পবিত্র মনে করা”এর অর্থ কী এ নিয়ে কয়েকটি বর্ণনা রয়েছে। যেমন:
হাসান বসরী ও কাতাদাহ (রহঃ) বলেন: ইয়াহূদীরা যে নিজেদেরকে পবিত্র মনে করে এর অর্থ হল: তারা বলে, আমরা আল্লাহ তা‘আলার ছেলে এবং প্রিয়পাত্র। (সূরা মায়িদাহ ৫:১৮)
তারা আরো বলে: কেবল ইয়াহূদী ও খ্রিস্টান ব্যতীত অন্য কেউ জান্নাতে যাবে না। (সূরা বাকরাহ ২:১১১) যহহাক (রহঃ) বলেন: তারা বলে, আমাদের কোন পাপ নেই, আমরা ছোট শিশুর মত নিষ্পাপ। আরো বলা হয় যে, এ আয়াতগুলো যারা নিজেদের আত্মপ্রশংসা ও ক্রটিমুক্ত মনে করে থাকে তাদের তিরস্কারের জন্য নাযিল হয়েছে। মোটকথা তারা নিজেরাই নিজেদের গুনাহ থেকে পবিত্র মনে করত, আল্লাহ তা‘আলার প্রিয়পাত্র বলে দাবী করত এবং আত্মপ্রশংসা করত।
এ সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, মিকদাদ (রাঃ) বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন আমরা যেন মুখোমুখি প্রশংসাকারীদের মুখে ধুলা ছিটিয়ে দেই। (সহীহ মুসলিম হা: ৩০০২)
অন্যত্র নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তোমরা মানুষের প্রশংসা করা থেকে বিরত থাক, কারণ তা যবাই করা। (ইবনু মাযাহ হা: ৩৭৪৩, সহীহ)
একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জনৈক ব্যক্তিকে অন্যের প্রশংসা করতে শুনলেন। তিনি বললেন: তোমার ধ্বংস হোক, তুমি তোমার সাথীর গর্দান কেটে দিলে। তারপর বললেন: তোমাদের কেউ যদি তার সাথীর প্রশংসা করতেই তাহলে যেন বলে: আমি তাকে এরূপ মনে করি, আল্লাহ তা‘আলার চেয়ে কাউকে পবিত্র করছি না। (সহীহ বুখারী হা:২৬৬২)
সুতরাং যে গুণ কারো মাঝে নেই এমন গুণের প্রশংসা করা এবং নিজের আত্মপ্রশংসা করা নিন্দনীয়। তাই অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা এ সকল ইয়াহুদ ও খ্রিস্টানসহ যারা তাদের মত মিথ্যা দাবী করবে, দোষ-ক্রটি ও অপরাধ থাকা সত্ত্বেও তা থেকে মুক্ত মনে করবে তাদেরকে তিরস্কার করছেন। বরং আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা তার ঈমান, সৎ আমল, উত্তম চরিত্রে চরিত্রবান, খারাপ আচরণ থেকে মুক্ত থাকার কারণে তাকে পবিত্র করেন।
সাধারাণতঃ অধিকাংশ মানুষ আত্মপ্রশংসা করে থাকে অহমিকা বা আত্মগর্ব করে, তাছাড়া শেষ পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কেউ জানেন না।
فَتِيلٌ এর অর্থ: খেজুরের আঁটির ফাটলে অতি সূক্ষ্ম ও পাতলা সুতোর মত যে অংশ থাকে সেটাকে ফাতীল বলা হয়। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা সামান্যটুকুও জুলুম করবেন না।
(يَفْتَرُوْنَ عَلَي اللّٰهِ الْكَذِبَ)
‘তারা আল্লাহ সম্পর্কে কিরূপ মিথ্যা অপবাদ দেয়’ অর্থাৎ ইয়াহূদী ও খ্রিস্টান নিজেদেরকে পবিত্র মনে করে, তারা আল্লাহ তা‘আলার ছেলে ও প্রিয়পাত্র এবং তারা ছাড়া কেউ জান্নাতে যাবে না ইত্যাদি দাবী করে আল্লাহ তা‘আলার ওপর মিথ্যারোপ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, এটাই তাদের মিথ্যুক হবার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَلَا تُزَكُّوْآ أَنْفُسَكُمْ ط هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقٰي)
“অতএব তোমরা নিজেদেরকে খুব পবিত্র মনে কর না, তিনিই ভাল জানেন মুত্তাকী কে।” (সূরা নাজম ৫৩:৩২)
৫১ নং আয়াতের শানে নুযূল:
একদা হুআই বিন আখতাব ও কা‘ব বিন আশরাফ মক্কায় আগমন করল। মক্কাবাসী বলল: তোমরা আহলে কিতাব ও জ্ঞানী মানুষ। আমাদেরকে আমাদের ও মুহাম্মাদের অবস্থান সম্পর্কে সংবাদ দাও। তারা বলল: তোমাদের সাথে মুহ্ম্মাাদের সম্পর্ক কী? তারা বলল: আমরা রক্ত সম্পর্ক বজায় রাখি, হাজীদের পানি পান করাই ইত্যাদি, আর মুহাম্মাদ আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে, কতকগুলো চোর হাজী তাঁর অনুসরণ করে। আমরা উত্তম, না মুহাম্মাদ উত্তম? তারা বলল: তোমরা উত্তম এবং সঠিক পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তখন এ আয়াত নাযিল হয়।
অত্র আয়াতে ইয়াহূদীদের কথা বলা হচ্ছে। তাদেরকে আসমানী কিতাব দেয়া সত্ত্বেও তারা জিবত তথা গণক ও জাদুতে বিশ্বাস করত এবং তাগুত তথা শয়তান ও প্রত্যেক মিথ্যা মা‘বূদে বিশ্বাস করত। অথচ এগুলো অস্বীকার করতে তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
এছাড়াও জিবত ও তাগুতের আরো অনেক অর্থ রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
ان العيافة والطرق والطيرة من الجبت
(রাঃ) নিশ্চয়ই পাখি উড়িয়ে, রেখা টেনে সুলক্ষণ ও কুলক্ষণ নির্ণয় করা জিবতের উপরে ঈমান আনার শামিল। (আবূ দাঊদ হা: ৩৯০৭)
সাহাবী আনাস (রাঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া যার ইবাদত করা হয় সে সব প্রত্যেক ব্যক্তি ও জিনিস তাগুত। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِیْ کُلِّ اُمَّةٍ رَّسُوْلًا اَنِ اعْبُدُوا اللہَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوْتَ)
“আল্লাহর ‘ইবাদত করার ও তাগূতকে বর্জন করার নির্দেশ দেবার জন্য আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি।”(সূরা নাহল ১৬:৩৬)
ইমাম ইবনু কায়্যিম (রহঃ) বলেন: তাগুত অনেক, তার মধ্যে পাঁচটি হল প্রধান, যথা- (১) আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া যার ইবাদত করা হয় এবং ঐ ইবাদতে সে সন্তুষ্ট, (২) যে ব্যক্তি গায়েব জানে বলে দাবী করে, (৩) শয়তান, (৪) যে ব্যক্তি নিজের ইবাদত করার প্রতি মানুষদেরকে আহ্বান করে এবং (৫) আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্যের বিধান দিয়ে ফায়সালা করা। (শরহু উসূলুস সালাসাহ)
সুতরাং তাগুতসহ অন্যান্য শির্কী বিষয় বর্জন না করা পর্যন্ত কোন ব্যক্তি মু’মিন হতে পারবে না যেমন ইয়াহূদীরা হতে পারেনি। যারা তাগুত মিশ্রিত দীন মানার চেষ্টা করবে, তাগুতের প্রতি বিশ্বাস রাখবে তাদের ওপর আল্লাহ তা’আলার লা’নত।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আত্মপ্রশংসা করা এবং নিজেকে ক্রটিমুক্ত মনে করা বৈধ নয়।
২. আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা ঊর্ধ্ব জগতে তাঁর পবিত্রতা ও প্রশংসা বর্ণনা করেন।
৩. আল্লাহ তা‘আলা কারো ওপর বিন্দু পরিমাণ জুলুম করেন না।
৪. জিবত ও তাগুতকে অস্বীকার করা ওয়াজিব।
৫. জিবত ও তাগুতকে বিশ্বাস করা শির্ক।
9 Fozlur Rahman
এরা হল তারা যাদেরকে আল্লাহ অভিশপ্ত করেছেন। আর আল্লাহ যাকে অভিশপ্ত করেন তার জন্য তুমি কোন সাহায্যকারী পাবে না।
10 Mokhtasar Bangla
৫২. যারা এ নিকৃষ্ট বিশ্বাসে বিশ্বাসী তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রহমত থেকে বিতাড়িত করেন। আর আল্লাহ যাকে বিতাড়িত করেন আপনি তার কোন সাহায্যকারী অভিভাবক কখনোই খুঁজে পাবেন না।
11 Tafsir Ibn Kathir
৪৯-৫২ নং আয়াতের তাফসীর:
হযরত হাসান বসরী (রঃ) এবং হযরত কাতাদাহ্ (রঃ) বলেন যে, اَلَمْ تَرَ اِلَى الَّذِیْنَ يُزَكُّوْنَ اَنْفُسَهُمْ-এ আয়াতটি ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টানদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। যখন তারা বলেছিলঃ “আমরা আল্লাহর পুত্র ও তাঁর প্রিয় পাত্র এবং আরও বলেছিলঃ ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টানদের ছাড়া কেউই জান্নাতে প্রবেশ লাভ করবে না।'
মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, তারা তাদের নাবালক ছেলেদেরকে দুআ ও নামাযে তাদের ইমাম করতো এবং তাদেরকে নিস্পাপ বলে ধারণা করতো। এও বর্ণিত আছে যে, তাদের ধারণায় তাদের যেসব ছেলে মারা গেছে তাদের মাধ্যমে তারা আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভ করবে এবং তারা তাদের জন্যে আল্লাহ পাকের নিকট সুপারিশ করবে ও তাদেরকে পবিত্র করবে। তাদের এ বিশ্বাস খণ্ডনে এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) ইয়াহূদীদের তাদের ছেলেদেরকে ইমাম করার ঘটনা বর্ণনা করে বলেনঃ তারা মিথ্যাবাদী। আল্লাহ তাআলা কোন পাপীকে কোন নিম্পাপের কারণে পবিত্র করেন না। তারা বলতোঃ আমাদের শিশুরা যেমন নিস্পাপ, দ্রুপ আমরাও নিস্পাপ।' এও বলা হয়েছে যে, হযরত মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ (রাঃ) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমরা যেন প্রশংসাকারীর মুখ মাটির দ্বারা পূর্ণ করে দেই।
সহীহ বুখারীর ও সহীহ মুসলিমের মধ্যে রয়েছে, হযরত আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর (রাঃ) তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি লোককে অন্য একটি লোকের প্রশংসা করতে শুনতে পেয়ে বলেনঃ ‘অফসোস! তুমি তোমার সঙ্গীর স্কন্ধ কেটে দিলে।' অতঃপর বলেনঃ 'যদি তোমাদের কারও কোন ব্যক্তির প্রশংসা করা অপরিহার্য হয়েই পড়ে তবে যেন সে বলে-আমি অমুক ব্যক্তিকে এরূপ মনে করি। কিন্তু সে প্রকৃতপক্ষেই আল্লাহ তা'আলার নিকট এরূপই পবিত্র এ কথা যেন না বলে।
মুসনাদ-ই-আহমাদে রয়েছে যে, হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) বলেনঃ “যে ব্যক্তি বলে-আমি আলেম সে মূর্খ এবং যে বলে -আমি জান্নাতী সে জাহান্নামী।' তাফসীর-ই-ইবনে মিরদুওয়াই-এর মধ্যে রয়েছে যে, হযরত উমার (রাঃ) বলেনঃ “তোমাদের উপর আমার সবচেয়ে ভয় এই যে, কেউ স্বীয় মতকেই পছন্দ করে। সুতরাং যে ব্যক্তি বলে যে, সে একজন মুমিন, সে কাফির। যে বলে যে, সে একজন আলেম সে মূর্খ এবং যে বলে যে, সে জান্নাতে রয়েছে। সে জাহান্নামে রয়েছে।'
মুসনাদ-ই-আহমাদে রয়েছে যে, হযরত মু'আবিয়া (রাঃ) খুব কম হাদীস বর্ণনা করতেন এবং খুব কম জম‘আই এরূপ গেছে যেখানে তিনি নিম্নের কথাগুলো বলেননিঃ ‘যার প্রতি আল্লাহ তা'আলা মঙ্গলের ইচ্ছে করেন তাকে তিনি ধর্মের বোধ শক্তি দান করেন। এ মাল হচ্ছে মিষ্ট ও সবুজ রঙ্গের। সুতরাং এটা যে তার হকের সাথে গ্রহণ করবে তার জন্যে তাতে বরকত দেয়া হবে। তোমরা একে অপরের প্রশংসা করা হতে বিরত হও। কেননা, এটা হচ্ছে যবেহু করারই তুল্য।' এ পরের বাক্যটি হযরত মুআবিয়া (রাঃ) হতে সুনান-ই-ইবনে মাজার মধ্যেও বর্ণিত রয়েছে।
ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেন যে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ সকালে মানুষ তার ধর্ম নিয়ে বের হয়। অতঃপর যখন সে ফিরে আসে তখন তার নিকট তার ধর্মের কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। (এভাবে যে,) সে কারও সাথে সাক্ষাৎ করে এবং তার প্রশংসা করতে আরম্ভ করে দেয় ও শপথ করে করে বলেঃ “নিশ্চয়ই আপনি এরূপই বটে, আপনি এরূপই বটে।' অথচ না সে তার ক্ষতির অধিকারী, না লাভের অধিকারী এবং এ কথাগুলোর পরেও হয়তো তার দ্বারা কোন কাজ হয় না। অথচ সে আল্লাহ তাআলাকে অসন্তুষ্ট করে দিলো। অতঃপর তিনি اَلَمْ تَرَ اِلَى الَّذِیْنَ يُزَكُّوْنَ اَنْفُسَهُمْ-এ আয়াতটি পাঠ। করেন। এর বিস্তারিত বর্ণনা فَلَا تَزَكُّوْا اَنْفُسَكُمْ (৫৩:৩২)-এ আয়াতের তাফসীরে ইনশাআল্লাহ আসবে। তাই, এখানে বলা হচ্ছেঃ বরং আল্লাহ তা'আলাই যাকে ইচ্ছে পবিত্র করেন। কেননা, সমুদয় জিনিসের মূলতত্ত্ব একমাত্র তিনিই জানেন। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘তারা সূত্র পরিমাণও অত্যাচারিত হবে না।' অর্থাৎ তিনি সূত্রের ওজন পরিমাণও কারোও পুণ্য ছেড়ে দেবেন না। فَتِيْل শব্দের অর্থ হচ্ছে খেজুরের আঁটির মধ্যস্থলের সূত্রটি। আবার এও বর্ণনা করা হয়েছে যে, ওটা হচ্ছে ঐ সূতা যা অঙ্গুলি দ্বারা পাকানো হয়।
এরপর আল্লাহ পাক বলেন- লক্ষ্য কর, কিরূপে তারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে!' যেমন তারা বলছে, আমরা আল্লাহর পুত্র ও প্রিয় পাত্র, ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টান ছাড়া আর কেউ জান্নাতে যাবে না, আমাদেরকে নির্দিষ্ট সামান্য কয়েক দিন জাহান্নামে থাকতে হবে। আর যেমন তারা তাদের পূর্বপুরুষের সত্ত্বার্যের উপর নির্ভর করে রয়েছে। অথচ একের কাজ অন্যকে কোন উপকার দেয় না। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেন-تِلْكَ اُمَّةٌ قَدْ خَلَتْ لَهَا مَا كَسَبَتْ وَ لَكُمْ مَّا كَسَبْتُمْ অর্থাৎ ‘ওটা একটা দল যা অতীত হয়েছে, তারা যা উপার্জন করেছে তা তাদের সঙ্গে এবং তোমরা যা উপার্জন করেছে তা তোমাদের সঙ্গে। (২:১৩৪)
এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেন যে, তাদের এসব কথা বলাই তাদের প্রকাশ্য অপরাধী হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) বলেন যে جِبْت শব্দের অর্থ হচ্ছে যাদু' এবং طَاغُوْت শব্দের অর্থ হচ্ছে শয়তান। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), আবুল আলিয়া (রঃ), মুজাহিদ (রঃ), আতা’ (রঃ), ইকরামা (রঃ), সাঈদ ইবনে যুবাইর (রঃ), শাবী (রঃ), হাসান বসরী (রঃ), যহ্হাক (রঃ) এবং সুদ্দীও (রঃ) একথাই বলেন। এও বলা হয়েছে যে, جِبْت হচ্ছে আবিসিনীয় শব্দ। ওর অর্থ হচ্ছে শয়তান। এটা শিরক, প্রতিমা, যাদুকর ইত্যাদি অর্থেও এসেছে। কেউ কেউ বলেন যে, এর দ্বারা হুয়াই ইবনে আখতাবকে বুঝান হয়েছে। আবার কারও কারও মতে এ হচ্ছে কাব ইবনে আশরাফ। হাদীসে রয়েছে যে, পাখীসমূহের নাম নিয়ে শুভাশুভ সূচিত করা এবং মাটিতে রেখা টেনে কার্যাবলীর মীমাংসা করা হচ্ছে جِبْت হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেন যে, جِبْت হচ্ছে শয়তানের গুন গুন শব্দ। طَاغُوْت শব্দের বিশ্লেষণ সূরা-ই-বাকারায় হয়ে গেছে, সুতরাং এখানে ওর পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন।
হযরত জাবির (রাঃ) طَاغُوْت সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে বলেনঃ তারা ছিল যাদুকর এবং তাদের নিকট শয়তান আসতো।' মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, তারা হচ্ছে মানুষ রূপী শয়তান। তাদের নিকট মানুষ তাদের বিবাদ নিয়ে উপস্থিত হয় এবং তাদেরকে বিচারক মেনে থাকে। হযরত ইমাম মালিক (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছে প্রত্যেক ঐ জিনিস, আল্লাহ তাআলা ছাড়া যার ইবাদত করা হয়।
এরপর আল্লাহ পাক বলেন- তাদের মূর্খতা, ধর্মহীনতা এবং স্বীয় গ্রন্থের সাথে কুফরী এত চরমে পৌছে গেছে যে, তারা কাফিরদেরকে মুসলমানদের উপর প্রাধান্য ও মর্যাদা দিয়ে থাকে। মুসনাদ-ই-আহমাদে হযরত ইকরামা (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হুয়াই ইবনে আখতাব এবং কা'ব ইবনে আশরাফ মক্কাবাসীদের নিকট আগমন করে। মক্কাবাসীরা তাদেরকে বলেঃ তোমরা আহলে কিতাব ও পণ্ডিত লোক। আচ্ছা বলতে আমরা ভাল, না মুহাম্মাদ (সঃ) ভাল? তখন তারা বলেঃ “তোমরা কি এবং মুহাম্মাদ (সঃ) কি? মক্কাবাসীরা বলেঃ আমরা আত্মীয়তার বন্ধন যুক্ত রাখি, উট যবেহ্ করে আহার করিয়ে থাকি, দুগ্ধ মিশ্রিত পানি পান করিয়ে থাকি, ক্রীতদাসদেরকে মুক্ত করিয়ে থাকি। হাজীদেরকে পানি পান করিয়ে থাকি। পক্ষান্তরে মুহাম্মাদ (সঃ) তো আমাদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করেছে এবং গেফার গোত্রের চোর হাজীরা তাঁর সঙ্গলাভ করেছে। এখন বলতো, আমরা ভাল, না সে ভাল? তখন ঐ দু’জন বলেঃ “তোমরাই ভাল। তোমরাই সোজা ও সঠিক পথে রয়েছ।
সে সময় এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। অন্য বর্ণনায় রয়েছে যে, তাদের ব্যাপারেই اِنَّ شَانِئَكَ هُوَ الْاَبْتَرُ-এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। বানূ অয়েল ও বা নাযীর গোত্রের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় লোক যখন আরবে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করছিল এবং ভয়াবহ যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল, সে সময় যখন তারা কুরাইশদের নিকট আগমন করে তখন কুরাইশরা তাদেরকে আলেম ও দরবেশ মনে করে জিজ্ঞেস করেঃ বলুন তো আমাদের ধর্ম উত্তম, না মুহাম্মাদ (সঃ)-এর ধর্ম উত্তম? ঐলোকগুলো বলেঃ “তোমাদের ধর্মই উত্তম এবং তোমরাই অধিকতর সঠিক পথে রয়েছে। সে সময় এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় এবং তাদেরকে অভিশপ্ত দল বলে ঘোষণা করা হয়। আরও বলা হয় যে, দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের কোন সাহায্যকারী নেই। তারা শুধু কাফিরদেরকে নিজেদের দলভুক্ত করার জন্যই তাদের জ্ঞানের বিপরীত এ তোষামোদমূলক কথাগুলো উচ্চারণ করছে। কিন্তু তাদের জেনে রাখা উচিত যে, তারা কৃতকার্য হতে পারে না। বাস্তবে হয়েছিলও তাই। তারা সমস্ত আরবকে দলভুক্ত করতঃ এ সম্মিলিত বিরাট সৈন্য বাহিনী নিয়ে মদীনার উপর আক্রমণ চালায়। ফলে রাসূলুল্লাহ (সঃ) মদীনার চতুর্দিকে পরিখা খনন করতে বাধ্য হন। অবশেষে সারা জগত দেখে নেয় যে, তাদের ষড়যন্ত্র তাদের উপরই প্রত্যাবর্তিত হয়। তারা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে আসতে হয়। আল্লাহ তা'আলাই মুসলমানদের জন্যে যথেষ্ট হয়ে যান এবং স্বীয় প্রতাপ ও ক্ষমতার বলে কাফিরদেরকে উল্টো মুখে নিক্ষেপ করেন।