৪৯-৫১ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
এখানে আল্লাহ তা‘আলা মানুষের একটি মন্দ অভ্যাসের কথা আলোচনা করেছেন। মানুষ প্রাচুর্যের লালসায় মোহিত। তার যত সম্পদ, সন্তান, ক্ষমতা ও সম্মান থাকে সে আরো বেশি কামনা করে। একটি বাড়ি থাকলে চায় আরেকটি বাড়ি যদি থাকত! এরূপ কামনা করতেই থাকে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আদম সন্তানের একটি স্বর্ণের পাহাড় থাকলে সে পছন্দ করে তার যদি দু’টি স্বর্ণের পাহাড় থাকত। (সহীহ বুখারী হা. ৬৪৩৯) সে কথাই আল্লাহ তা‘আলা এখানে বলছেন- মানুষ তার জন্য সম্পদ, ক্ষমতা, রাজত্ব ও সম্মান চাইতে বিরক্ত বোধ করে না। কিন্তু যখন কোন আপদ-বিপদ যেমন অসুস্থতা, দরিদ্রতা ইত্যাদি দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন আল্লাহ তা‘আলার রহমত থেকে নিরাশ হয়ে যায়, মনে করে এ বিপদে সে ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে যারা মু’মিন তারা নয়, কারণ তাদেরকে কোন বিপদ আক্রান্ত করলে ধৈর্য ধারণ করে এটা তাদের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَلَئِنْ أَذَقْنٰهُ رَحْمَةً)
অর্থাৎ যে ব্যক্তি ধন-সম্পদ চাইতে বিরক্ত হয় না তাকে যদি বিপদাপদ আক্রান্ত করে, আর আল্লাহ তা‘আলা সে বিপদ থেকে মুক্তি দান করেন তাহলে সে শুকরিয়া আদায় করে না, বরং সে বাড়াবাড়ি করে ও বড়ত্ব্ প্রকাশ করে বলে- আমি এটার হকদার বলেই আমাকে তা দেয়া হয়েছে।
মুজাহিদ বলেন :
(لَيَقُوْلَنَّ هٰذَا لِيْ)
‘সে বলেই থাকে : এটা আমার প্রাপ্য’ মানুষ বিপদাপদে আক্রান্ত হওয়ার পর আল্লাহ তা‘আলা তা থেকে মুক্তি দিলে সে বলে এটা আমার কর্মের ফল ও আমি এর হকদার। মূলত এটা আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতকে অস্বীকার করা। ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) বলেন : শুকরিয়ার মূল হল- নেয়ামত দানকারীকে বিনয়-নম্রতা ও মহব্বতের সাথে স্মরণ করা ও নেয়ামতকে স্বীকার করা। যে ব্যক্তি নেয়ামতকে চিনতে পারল না সে শুকরিয়া আদায় করতে পারবে না। আর যে নেয়ামতকে চিনল কিন্তু যিনি নেয়ামত দান করেছেন তাঁকে চিনল না সে ব্যক্তিও নেয়ামতের যথার্থ শুকরিয়া আদায় করতে সক্ষম হয় না। নেয়ামত ও নেয়ামত দানকারীকে চেনার পর অস্বীকার করলে নেয়ামতের সাথে কুফরী করা হয়। যে ব্যক্তি নেয়ামতকে চিনল এবং যিনি নেয়ামত দান করেছেন তাকেও চিনল অস্বীকারও করল না কিন্তু তার প্রতি বিনয়ী ও সন্তুষ্টি প্রকাশ করল না এবং তা ভালবাসল না সেও নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করল না। সুতরাং যে ব্যক্তি নেয়ামত চিনল, নেয়ামত দানকারীকে চিনল এবং তা স্বীকার করল এবং তার প্রতি বিনয়ী হল সে ব্যক্তিই নেয়ামতের যথার্থ শুকরিয়া আদায় করতে পারবে। (মাদারিজুস সালিকীন ২ : ১৩৫-১৪৪) যেমন বানী ইসরাঈলের তিন ব্যক্তি, একজনের কুষ্ট রোগ ছিল, আরেকজনের মাথায় টাক ছিল, অন্য জন অন্ধ ছিল।
আল্লাহ তা‘আলার রহমতে তিনজন আরোগ্য লাভ করে। প্রথম দুজন নেয়ামত অস্বীকার করে, ফলে তাদের নেয়ামত ছিনিয়ে নেয়া হয়, তৃতীয়জন স্বীকার করে ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে প্রদত্ত নেয়ামত বহাল রাখেন। (সহীহ বুখারী হা. ৩৪৬৪)
(وَمَآ أَظُنُّ السَّاعَةَ قَا۬ئِمَةً)
‘আমি মনে করি না যে, কিয়ামত সংঘটিত হবে’ অর্থাৎ সে পুনরুত্থানকে অস্বীকার করে।
(وَّلَئِنْ رُّجِعْتُ إِلٰي رَبِّيْٓ...)
অর্থাৎ ‘যদি কিয়ামত হয়ই তাহলে আমি আল্লাহ তা‘আলার কাছে ফিরে যাব এমন অবস্থায় যে, তার কাছে আমার উত্তম প্রতিদান রয়েছে।’ যেমন আমার দুনিয়াতে অনেক সম্পদ ছিল, আখিরাতেও আমার জন্য এরূপ থাকবে। এটা আল্লাহ তা‘আলার প্রতি বানিয়ে কথা বলা এবং তাঁর সাথে স্পর্ধা দেখানো। আল্লাহ তা‘আলা তাকে ধমক দিয়ে পরের কথাগুলো বলেছেন।
(فَذُوْ دُعَا۬ءٍ عَرِيْضٍ)
‘দীর্ঘ প্রার্থনায় রত হয়ে যায়’ অর্থাৎ বেশি বেশি দু’আ করতে থাকে। কারণ সে বিপদে ধৈর্য ধারণ করতে পারে না এবং সাচ্ছন্দ্যের সময় শুকরিয়া আদায় করতে পারে না। তবে আল্লাহ তা‘আলা যাকে রহমত ও অনুগ্রহ করেছেন সে ব্যতীত। এ সম্পর্কে পূর্বে সূরা ইউনুস-এর ১২ নম্বর আয়াত, সূরা আল কাহ্ফ-এর ৩৬ নম্বর আয়াতসহ অন্যান্য স্থানেও আলোচনা করা হয়েছে।
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার প্রত্যেক নেয়ামতের যথাযথ শুকরিয়া আদায় করা প্রতিটি মু’মিন-মুসলিমের একান্ত কর্তব্য। আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামত পাওয়ার শুকরিয়া আদায় না করা নেয়ামতকে অস্বীকার করার শামিল। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তাঁর নেয়ামত চিনে যথাযথ শুকরিয়া আদায় করার তাওফীক দান করুন। (আমীন)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখে সর্বদা আল্লাহ তা‘আলাকে ডাকতে হবে এবং তাঁরই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে। বিপদে পড়ে আল্লাহ তা‘আলাকে ডাকব আর সুখের সময় তাঁর সাথে কুফরী করব এমনটি করা যাবে না।
২. বিপদে পড়ে নিরাশ হওয়া যাবে না এবং সুখে অতি আনন্দিতও হওয়া যাবে না।
৩. প্রত্যেক নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা আবশ্যক।