৫০-৫৯ নং আয়াতের তাফসীরঃ
কাফির ও মুশরিকরা মৃত্যুকালে যে যন্ত্রণা ও আযাবের সম্মুখীন হয় এ আয়াতে তার বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: মুশরিকরা যখন মুসলিমদের দিকে অগ্রসর হত, তখন মুসলিমরা তাদের চেহারায় তরবারী দ্বারা আঘাত করত। তা হতে বাঁচার জন্য তারা পিছনে ফিরে পলায়ন করত। তখন ফেরেশতাগণ তাদের পশ্চাতে তরবারী দ্বারা আঘাত করত। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
মানুষের আত্মা কবযকারী ফেরেশতা যখন কাফিরদের আত্মা কবয করার জন্য আসে তখন তাদের মুখে ও পশ্চাতে আঘাত করতে থাকে আর বলতে থাকে- হে খারাপ কাজে তৃপ্তিপ্রাপ্ত আত্মা আল্লাহ তা‘আলার গযবের দিকে বের হয়ে আস। এসব কথা এজন্য বলে যাতে জানতে পারে যে, সামনে তাদের জন্য আরো কঠিন শাস্তি রয়েছে।
(وَأَنَّ اللّٰهَ لَيْسَ بِظَلَّامٍ لِّلْعَبِيْدِ)
‘আল্লাহ তো তার বান্দাদের প্রতি অত্যাচারী নয়।’ অর্থাৎ তাদের এসব শাস্তির কারণ তাদের কৃতকর্ম। কেননা আল্লাহ তা‘আলা কারো প্রতি জুলুম করেন না। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: হে আমার বান্দা, আমি নিজের ওপর জুলুম করা হারাম করেছি এবং তোমাদের মাঝে তা হারাম করেছি। অতএব তোমরা পরস্পর জুলুম করো না। (সহীহ মুসলিম হা: ১৯৯৪, মুসনাদ আহমাদ: ৫/১৬০)
(بِأَنَّ اللّٰهَ لَمْ يَكُ مُغَيِّرًا نِعْمَةً)
‘এটা এজন্য যে, যদি কোন সম্প্রদায় নিজের অবস্থার পরিবর্তন না করে তবে আল্লাহ এমন নন যে, তিনি তাদেরকে যে সম্পদ দান করেছেন, সেটা পরিবর্তন করবেন; অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত কোন জাতি নেয়ামত অস্বীকারের পথ অবলম্বন করে এবং আল্লাহ তা‘আলার আদেশ ও নিষেধ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজেদের অবস্থা ও আচরণকে বদলে না নেবে ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা পাপের কারণে নিজ নেয়ামতকে ছিনিয়ে নেবেন না। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنَّ اللّٰهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتّٰي يُغَيِّرُوْا مَا بِأَنْفُسِهِمْ ط وَإِذَآ أَرَادَ اللّٰهُ بِقَوْمٍ سُوْ۬ءًا فَلَا مَرَدَّ لَه۫ ج وَمَا لَهُمْ مِّنْ دُوْنِه۪ مِنْ وَّالٍ)
“এবং আল্লাহ কোন সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে। কোন সম্প্রদায়ের সম্পর্কে যদি আল্লাহ অশুভ কিছু ইচ্ছা করেন তবে তা মোকাবেলা করার নয় এবং তিনি ব্যতীত তাদের কোন অভিভাবক নেই।” (সূরা রা‘দ ১৩:১১)
(اِنَّ شَرَّ الدَّوَا۬بِّ عِنْدَ اللّٰهِ)
‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট নিকৃষ্ট জীব তারাই..’ খারাপ জীব ব্যবহার করা হয় চতুষ্পদ জন্তুর ক্ষেত্রে। কিন্তু তা কাফিরদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে, এতে বুঝা গেল তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত জীব, এরা মানুষ নয়। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَقَدْ ذَرَأْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِيْرًا مِّنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِﺘ لَهُمْ قُلُوْبٌ لَّا يَفْقَهُوْنَ بِهَا ز وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لَّا يُبْصِرُوْنَ بِهَا ز وَلَهُمْ اٰذَانٌ لَّا يَسْمَعُوْنَ بِهَا ط أُولٰ۬ئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ ط أُولٰ۬ئِكَ هُمُ الْغٰفِلُوْنَ)
“আমি তো বহু জিন ও মানবকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি, তাদের হৃদয় আছে কিন্তু তারা তা দ্বারা উপলব্ধি করে না, তাদের চক্ষু আছে কিন্তু তারা তা দ্বারা দেখে না, এবং তাদের কর্ণ আছে কিন্তু তারা তা দ্বারা শ্রবণ করে না, তারাই পশুর ন্যায়, বরং তারা অধিক বিভ্রান্ত। তারাই গাফিল।" (সূরা আ‘রাফ ৭:১৭৯)
(فَشَرِّدْ بِهِمْ) ‘তাদেরকে শাস্তি দিবে’ অর্থাৎ তাদেরকে এমনভাবে প্রহার কর যাতে তাদের পশ্চাতে তাদের পৃষ্ঠপোষক এবং সাথীদের মাঝে পলায়নপর অবস্থা সৃষ্টি হয়ে যায়। এমনকি তারা তোমাদের দিকে এ আশঙ্কায় অগ্রসর না হয় যে, হতে পারে তাদেরও সেই অবস্থা হবে, যে অবস্থা তাদের পূর্ববর্তীদের হয়েছিল।
(خِيَانَةً فَانْۭبِذْ إِلَيْهِمْ)
‘তুমি তাদের দিকে সমানভাবে ছুঁড়ে মার (যাতে উভয়দল জানতে পারে তাদের মাঝে আজ থেকে কোন চুক্তি নেই); অর্থাৎ যদি সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ কোন জাতির পক্ষ থেকে চুক্তি ভঙ্গের আশঙ্কা কর তাহলে তাদের দিকে তাদের চুক্তি ছুঁড়ে মার। অর্থাৎ চুক্তি বাতিল করে দাও যাতে জেনে নেয়, আজ থেকে কোন চুক্তি নেই। কারণ তাদের সাথে চুক্তি নেই, এমনটি না জানিয়ে আক্রমণ করা বৈধ নয়। মুআবিয়াহ (রাঃ) এবং রোমকদের মাঝে একটি সন্ধিচুক্তি ছিল। যখন চুক্তির মেয়াদ শেষের দিকে তখন মুআবিয়াহ (রাঃ) রোমকদের সীমান্ত এলাকার নিকট নিজের সৈন্যদল একত্রিত করতে লাগলেন। উদ্দেশ্য ছিল সন্ধিচুক্তি শেষ হবার সাথে সাথে রোমকদের ওপর হামলা চালাবেন। আমর বিন আবাসাহ (রাঃ)-এর নিকট এ খবর পৌঁছলে তিনি এটাকে প্রতারণা বলে আখ্যায়িত করলেন। এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হাদীস উল্লেখ করে এ আক্রমণকে সন্ধিচুক্তির পরিপন্থী বলে মন্তব্য করলেন। এ কথা শুনে মুআবিয়াহ (সাঃ) তার সৈন্য প্রত্যাহার করে নিলেন। (মুসনাদে ৪/১১১, আবূ দাঊদ হা: ২৭৫৯, তিরমিযী হা: ১৫৮০, সহীহ)
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কাফিররা মৃত্যুকালে কঠিন যন্ত্রণার স্বীকার হয়।
২. তাদের শাস্তির কারণ হচ্ছে তাদের কৃতকর্ম।
৩. আল্লাহ তা‘আলা কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন ঘটান না যতক্ষণ না নিজেরা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটায়।
৪. কাফিররা আল্লাহ তা‘আলার কাছে নিকৃষ্ট জাতি।
৫. কেউ অঙ্গীকার ভঙ্গ করলে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।