আল ওয়াক্বিয়া আয়াত ৮২
وَتَجْعَلُوْنَ رِزْقَكُمْ اَنَّكُمْ تُكَذِّبُوْنَ ( الواقعة: ٨٢ )
Wa taj'aloona rizqakum annakum tukazziboon (al-Wāqiʿah ৫৬:৮২)
English Sahih:
And make [the thanks for] your provision that you deny [the Provider]? (Al-Waqi'ah [56] : 82)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
আর তাকে মিথ্যে বলাকেই তোমরা তোমাদের জীবিকা বানিয়ে নিয়েছ। (আল ওয়াক্বিয়া [৫৬] : ৮২)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
এবং তোমরা মিথ্যাজ্ঞানকেই তোমাদের উপজীব্য করে নেবে?
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
আর তোমরা মিথ্যারোপকেই তোমাদের রিযিক করে নিয়োছ [১] !
[১] অর্থাৎ আল্লাহর নেয়ামতকে দেখেও তোমরা সেগুলোকে অস্বীকার করে যাচ্ছ। তোমরা কৃতজ্ঞ হওয়ার পরিবর্তে কৃতঘ্ন হচ্ছ। তোমরা আল্লাহর নেয়ামতকে অন্যের দিকে সম্বন্ধযুক্ত করছ। তোমরা শুকরিয়া আদায়ের জায়গায় কুফরী করছ। [ফাতহুল কাদীর] হাদীসে এসেছে, যায়েদ ইবন খালেদ আল-জুহানী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে নিয়ে হুদাইবিয়াতে ফজরের সালাত আদায় করেন। তার আগের রাত্রিতে বৃষ্টি হয়েছিল। সালাত শেষ করে রাসূল মানুষের দিকে ফিরে বললেন, তোমরা কি যান তোমাদের রব কি বলেছেন? সাহাবাগণ বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভাল জানেন। তিনি বললেন, আল্লাহ বলেছেন, আমার বান্দাদের মধ্যে কেউ ঈমানদার আর কেউ কাফের এ দু'ভাগ হয়ে গেছে। যারা বলেছে আমরা আল্লাহর রহমতে বৃষ্টি লাভ করেছি তারা আমার উপর ঈমান এনেছে নক্ষত্রপুঞ্জের প্রভাব অস্বীকার করেছে। আর যারা বলেছে আমরা ওমুক ওমুক নক্ষত্রের নিকটবর্তী হওয়ার কারণে বৃষ্টি লাভ করেছি তারা আমার সাথে কুফরী করেছে এবং নক্ষত্রপুঞ্জের উপর ঈমান এনেছে। [বুখারী; ১০৩৮, মুসলিম; ৭১]
3 Tafsir Bayaan Foundation
আর তোমরা তোমাদের রিয্ক বানিয়ে নিয়েছ যে, তোমরা মিথ্যা আরোপ করবে।
4 Muhiuddin Khan
এবং একে মিথ্যা বলাকেই তোমরা তোমাদের ভূমিকায় পরিণত করবে?
5 Zohurul Hoque
এবং তোমাদের জীবিকা বানিয়ে নিয়েছ যে তোমরা মিথ্যা আখ্যা দেবে?
6 Mufti Taqi Usmani
এবং তোমরা (এর প্রতি) অবিশ্বাসকেই তোমাদের উপজীব্য বানিয়ে নিয়েছ?
7 Mujibur Rahman
এবং তোমরা মিথ্যারোপকেই তোমাদের উপজীব্য করে নিয়েছ!
8 Tafsir Fathul Mazid
৭৫-৮২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
فَلَآ أُقْسِمُ এখানে لا আরবী অক্ষরটি কতক মুফাসসিরদের মতে অতিরিক্ত। মূল বাক্য হল
(أُقْسِمُ بِمَوَاقِعِ النُّجُوْمِ)।
আর কতক মুফাসসিরগণ বলেছেন : এখানে لا অক্ষরটি অতিরিক্ত না, তবে তার কোন অর্থ এখানে হবে না। বরং এরূপ নিয়ে আসা হয় তখন, যখন না বোধক বিষয়ে শপথ করা হয়। এরূপ সূরা কিয়ামার শুরুতে আছে।
(بِمَوَاقِعِ النُّجُوْمِ)
এর অর্থ নিয়ে কয়েকটি মতামত পাওয়া যায়। যেমন : ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : এর অর্থ হল কুরআনের অবতরণ। কুরআন কদরের রাতে ঊর্ধ্বাকাশ থেকে দুনিয়ার আকাশে একত্রে অবতীর্ণ হয়। অতঃপর প্রয়োজন মত দুনিয়াতে অবতীর্ণ হতে থাকে। এভাবে কয়েক বছরে পূর্ণ কুরআন অবতীর্ণ হয়। তারপর ইবনু আব্বাস (রাঃ) এ আয়াত তেলাওয়াত করেন। মুজাহিদ (রহঃ) বলেন : আকাশে নক্ষত্ররাজির অস্তাচল। যেমন বলা হয়
مطالعها ومشارقها
হাসান বাসরী ও কাতাদাহ (রহঃ) এ কথা বলেছেন। ইবনু জারীর (রহঃ) এ মত পছন্দ করেছেন।
অন্যত্র হাসান বাসরী (রহঃ) বলেন : এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল কিয়ামতের দিন যখন তারকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে। (ইবনু কাসীর)
এখানে مَوَاقِعِ দ্বারা উদ্দেশ্য তারকারজির উদয়াচল ও অস্তাচল এবং তাদের গন্তব্যস্থল ও কক্ষপথ।
(وَإِنَّه۫ لَقَسَمٌ لَّوْ تَعْلَمُوْنَ عَظِيْمٌ)
অর্থাৎ অবশ্যই এটা এক মহা শপথ। কেননা, তারকার উদয় অস্তর গন্তব্য ও চলার কক্ষপথ একটি সীমাহীন বড় ধরণের নিদর্শন।
(إِنَّه۫ لَقُرْاٰنٌ كَرِيْمٌ)
‘নিশ্চয়ই এটা সম্মানিত কুরআন’ এ আয়াতটি পূর্বের আয়াতের শপথের জবাব। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তারকার উদয় ও অস্তাচলের শপথ করে বলছেন যে, নিশ্চয়ই এ কুরআন একটি সম্মানিত কুরআন, এটা সাধারণ কোন বিদ্যা নয়। এতে যা কিছু রয়েছে তাতে কোন সংশয় নেই, তা আল্লাহর কালাম- নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জন্য চিরস্থায়ী মু‘জিযাহ।
مَّكْنُوْنٍ অর্থ مستور عن عين الخلق
বা মানুষের দৃষ্টির আড়াল। ইবনুল কায়্যিম (রহঃ) বলেন : এর উদ্দেশ্য কী তা নিয়ে একাধিক মত পাওয়া যায়, কেউ বলেন : এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল লাওহে মাহফূজ। অর্থাৎ এ কুরআন লাওহে মাহফুজে লিপিবদ্ধ, সংরক্ষিত। সঠিক কথা হল : ফেরেশতাদের হাতে যে কিতাব রয়েছে এখানে সে কিতাব উদ্দেশ্য। যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :
(فِیْ صُحُفٍ مُّکَرَّمَةٍﭜﺫ مَّرْفُوْعَةٍ مُّطَھَّرَةٍۭﭝبِاَیْدِیْ سَفَرَةٍﭞکِرَامٍۭ بَرَرَةٍ)
“তা সম্মানিত কিতাবে (লাওহ মাহফূজে) লিপিবদ্ধ যা উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন পবিত্র। এমন লেখকদের হাতে থাকে। যারা সম্মানিত ও সৎ।” (সূরা আবাসা ৮০ : ১৩-১৬)
(لَّا یَمَسُّھ۫ٓ اِلَّا الْمُطَھَّرُوْنَ)
পূতপবিত্রগণ ছাড়া অন্য কেউ তা স্পর্শ করে না। আয়াতের তাফসীরে বিভিন্ন মুফাসসিরদের মতামত তুলে ধরা হল :
১. তাফসীর মুয়াসসারে বলা হয়েছে : মাত্র ঐসকল ফেরেশতারাই কুরআন স্পর্শ করে যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা সকল প্রকার আপদ-বিপদ (أفات) ও গুনাহ থেকে পবিত্র করে রেখেছেন। অনুরূপভাবে এ কুরআনকে যারা শিরক ও অপবিত্রতা থেকে মুক্ত তারাই স্পর্শ করবে। (তাফসীর মুয়াসসার)
২. আয়সারুত তাফাসীরে বলা হয়েছে : কুরআন চাই লাওহে মাহফূজে হোক আর কপি আকারে আমাদের হাতে থাকুক তা ছোট-বড় সকল প্রকার অপবিত্রতা থেকে মুক্ত ব্যক্তিরাই স্পর্শ করবে। (আয়সারুত তাফাসীর)
৩. আল্লামা সা‘দী (রহঃ) বলেন : কুরআন সম্মানিত ফেরেশতা ছাড়া কেউ স্পর্শ করতে পারবে না, যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা বিপদ, গুনাহ ও ত্র“টি থেকে মুক্ত রেখেছেন। সুতরাং যখন পবিত্র ফেরেশতা ছাড়া তা স্পর্শ করতে পারবে না তখন শয়তান ও অপবিত্র কেউ স্পর্শ করার কোন প্রশ্নই আসে না। এ আয়াত (সতর্ককারীস্বরূপ) প্রমাণ করছে যে, কুরআন পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া স্পর্শ করতে পারবে না। (তাফসীর সা‘দী)
ইবনু আব্বাস (রাঃ)-সহ প্রমুখ সাহাবী ও তাবেয়ী বলেন : আয়াতে কিতাব দ্বারা আকাশে যে কিতাব আছে তা উদ্দেশ্য, আর পবিত্রগণ দ্বারা ফেরেশতা উদ্দেশ্য।
কাতাদাহ (রহঃ) বলেন : আল্লাহ তা‘আলার কাছে যে কিতাব আছে তা পবিত্রগণ ছাড়া কেউ স্পর্শ করতে পারে না। আর দুনিয়ায় যে কুরআন আছে তা অপবিত্র অগ্নিপূজক, মুনাফিক সবাই স্পর্শ করে থাকে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রোম ও পারস্যসহ বিভিন্ন অমুসলিম রাষ্ট্র প্রধানের কাছে কুরআনের আয়াত সম্বলিত চিঠি প্রেরণ করেছেন। তারা তা স্পর্শ করেছে। বিশিষ্ট তাবেয়ী আবুল আলিয়া (রহঃ) উক্ত মতকে সমর্থন করে বলেন : এ আয়াত দ্বারা তোমরা পাপাচারীরা উদ্দেশ্য না। ইবনু জায়েদ (রহঃ) বলেন : কুরাইশদের কাফিররা ধারণা করত এ কুরআন শয়তান নিয়ে এসেছে। তাই আল্লাহ তা‘আলা বলে দিলেন, এ কুরআন পবিত্রগণ ছাড়া কেউ স্পর্শ করে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَمَا تَنَزَّلَتْ بِھِ الشَّیٰطِیْنُﰡوَمَا یَنْۭبَغِیْ لَھُمْ وَمَا یَسْتَطِیْعُوْنَﰢ اِنَّھُمْ عَنِ السَّمْعِ لَمَعْزُوْلُوْنَ)
“শয়তানরা (এ কুরআন) তাসহ অবতীর্ণ হয়নি। তারা এ কাজের যোগ্য নয় এবং তারা এটার সামর্থ্যও রাখে না। তাদেরকে (ওয়াহী) শ্রবণের সুযোগ হতে দূরে রাখা হয়েছে।” ( সূরা শুয়ারা ২৬ : ২১০-২১২)
ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : এ কথাটা উত্তম, তবে এ কথা পূর্বের কথাগুলোর বিপরীত নয়।
অন্যান্যরা বলেন : যারা ছোট ও বড় সকল প্রকার অপবিত্রতা থেকে মুক্ত তারাই এ কুরআন স্পর্শ করবে। এমতাবস্থায় لَّا یَمَسُّھ۫ٓ সংবাদসূচক বাক্যটির অর্থ হবে নিষেধসূচক, অর্থাৎ পবিত্রতা ছাড়া কুরআনের কপি স্পর্শ কর না। যেমন নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : পবিত্রতা ছাড়া কুরআন স্পর্শ করবে না। (আবূ দাঊদ (মারাসিল) হা. ৯৪, সহীহুল জামে হা. ৭৭৮০)
উক্ত আলোচনা থেকে বুঝা গেল উক্ত আয়াতটি যদিও লাওহে মাহফূজে অবস্থিত কুরআন ও ফেরেশতাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে কিন্তু মানুষেরাও এ সম্বোধনের অন্তর্ভুক্ত। তাই মুসলিমদের পবিত্র অবস্থা ছাড়া কুরআনকে স্পর্শ করা উচিত নয়। আল্লাহ তা‘আলা ভাল জানেন।
(أَفَبِهٰذَا الْحَدِيْثِ)
এখানে حديث দ্বারা কুরআন উদ্দেশ্য।
مُّدْهِنُوْنَ - এর এখানে অর্থ হল : মিথ্যাপ্রতিপন্ন করা। অর্থাৎ তোমরা এ সম্মানিত কুরআন যা পবিত্র ফেরেশতা ছাড়া কোন শয়তান স্পর্শ করতে পারে না তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করছ?
(وَتَجْعَلُوْنَ رِزْقَكُمْ...)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) এ আয়াতের তাফসীর করে বলেন : তোমরা আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় না করে মিথ্যে প্রতিপন্ন কর ও কুফরী কর। (ইবনু কাসীর) যেমন বৃষ্টি পাওয়া একটি নেয়ামত। তোমরা আল্লাহ তা‘আলার এ নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় না করে বলে থাক, অমুক তারকার কারণে বৃষ্টি পেয়েছি বা অমুক কারণে বৃষ্টি পেয়েছি। মূলত তোমাদের উচিত ছিল আল্লাহ তা‘আলার এ নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা। তোমরা তা না করে অমুক অমুক কথা বলছ।
জায়েদ বিন খালেদ (রাঃ) বলেন : একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাতের বৃষ্টি শেষে হুদায়বিয়াতে আমাদের নিয়ে ফজরের সালাত আদায় করেন। সালাত শেষে সাহাবীদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন : তোমরা কি জান, তোমাদের প্রতিপালক কী বলেন? তারা বলল : আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভাল জানেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন : আমার একশ্রেণির বান্দা সকাল করে মু’মিন অবস্থায়, আরেক শ্রেণি সকাল করে কাফির অবস্থায়। যারা বলে : আল্লাহ তা‘আলার রহমতে বৃষ্টি অবতীর্ণ হয়েছে তারা আমার প্রতি ঈমানদার তারকার প্রতি কাফির। আর যারা বলে : অমুক অমুক তারকার কারণে বৃষ্টি হয়েছে তারা আমার প্রতি কাফির তারকার প্রতি বিশ্বাসী।
সুতরাং একজন মু’মিন যে কোন প্রকার রিযিক পেয়ে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করবে, রিযিক পেয়ে বলবে না যে, অমুক কারণে এ রিযিক পেয়েছি।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. কুরআনের সম্মান ও মর্যাদা জানলাম।
২. কুরআন পবিত্র অবস্থায় ধরা ও পাঠ করা আবশ্যক।
৩. কোন তারকা উদয়ের কারণে বৃষ্টি হয় না বরং বৃষ্টি আল্লাহ তা‘আলার একটি নেয়ামত যখন ইচ্ছা তা দিয়ে থাকেন। তাই সকল নেয়ামতের জন্য একমাত্র তাঁরই শুকরিয়া আদায় করা উচিত।
9 Fozlur Rahman
এবং তোমাদের জীবিকার জন্য কৃতজ্ঞতার পরিবর্তে অবিশ্বাস করবে? (অর্থাৎ আল্লাহর নেয়ামতের জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পরিবর্তে তাঁকে অবিশ্বাস করবে?)
10 Mokhtasar Bangla
৮২. আর আল্লাহ নিয়ামত স্বরূপ তোমাদেরকে যে উপজীবিকা প্রদান করেছেন সেটির শুকরিয়া হিসেবে তোমরা সেটির প্রতি মিথ্যারোপ করছো। ফলে তোমরা বৃষ্টিকে তারকার প্রতি সম্বন্ধ করছো। তাই তোমরা বলছো যে, আমাদেরকে অমুক অমুক তারকার সাহায্যে বৃষ্টি প্রদান করা হয়েছে?!
11 Tafsir Ibn Kathir
৭৫-৮২ নং আয়াতের তাফসীর:
হযরত যহ্হাক (রঃ) বলেন যে, আল্লাহ তা'আলার এই কসমগুলো কালাম শুরু করার জন্যে হয়ে থাকে। কিন্তু এই উক্তিটি দুর্বল। জমহুর বলেন যে, এটা আল্লাহ তা'আলার কসম, তিনি তার মাখলুকের মধ্যে যার ইচ্ছা কসম খেতে পারেন এবং এর দ্বারা ঐ জিনিসের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। কোন কোন মুফাসসিরের উক্তি এই যে, এখানে لَا অতিরিক্ত এবং اِنَّهٗ لَقُرْاٰنٌ ـ ـ ـ হলো কসমের জবাব। এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রঃ) হতে বর্ণনা করেছেন। অন্যেরা বলেন যে, এখানে لَا-কে অতিরিক্ত বলার কোন প্রয়োজনই নেই। কালামে আরবের প্রথা হিসেবে এটা কসমের শুরুতে এসে থাকে। যখন কোন জিনিসের উপর কসম খাওয়া হয় এবং ওটাকে অস্বীকার করা উদ্দেশ্য হয় তখন কসমের শুরুতে এই لَا এসে থাকে। যেমন হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর নিম্নের উক্তিতে রয়েছেঃ
لَا وَاللهِ مَا مَسَّتْ يَدُ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَدَ امْرَاَةٍ قَطُّ
অর্থাৎ “আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হাত কখনো কোন স্ত্রীলোকের হাতকে স্পর্শ করেনি।” অর্থাৎ বায়আত গ্রহণের সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) কখনো কোন নিঃসম্পর্ক স্ত্রীলোকের সাথে মুসাফাহা বা করমর্দন করেননি। অনুরূপভাবে এখানেও। কসমের শুরুতে নিয়ম অনুযায়ী এসেছে, অতিরিক্ত হিসেবে নয়। তাহলে কালামের ভাবার্থ হবেঃ কুরআন কারীম সম্পর্কে তোমাদের যে ধারণা আছে যে, এটা যাদু, এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। বরং এ পবিত্র কিতাবটি আল্লাহর কালাম। কোন কোন আরব বলেন যে, لَا দ্বারা তাদের কালামকে অস্বীকার করা হয়েছে। অতঃপর আসল বিষয়ের স্বীকৃতি শব্দে রয়েছে।
مَوَاقِعُ النُّجُوْمِ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো কুরআন কারীম ক্রমান্বয়ে অবতীর্ণ হওয়া। লাওহে মাহফুয হতে তো কদরের রাত্রিতে কুরআন কারীম একই সাথে প্রথম আসমানে অবতীর্ণ হয়। তারপর প্রয়োজন মত অল্প অল্প করে সময়ে সময়ে অবতীর্ণ হতে থাকে।
এই ভাবে কয়েক বছরে পূর্ণ কুরআন অবতীর্ণ হয়। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, আসমানের সূর্যোদয়ের জায়গাকে বুঝানো হয়েছে। مَوَاقِعِ দ্বারা مَنَازِل উদ্দেশ্য। হাসান (রঃ) বলেন যে, কিয়ামতের দিন ঐগুলো বিক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়া উদ্দেশ্য। যহাক (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা ঐ তারকাগুলোকে বুঝানো হয়েছে যেগুলো সম্পর্কে মুশরিকদের আকীদা বা বিশ্বাস ছিল যে, অমুক অমুক তারকার কারণে তাদের উপর বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে।
এরপর ঘোষিত হচ্ছেঃ অবশ্যই এটা এক মহাশপথ! কেননা, যে বিষয়ের উপর শপথ করা হচ্ছে তা খুবই বড় বিষয়। অর্থাৎ এই কুরআন বড়ই সম্মানিত কিতাব। এটা বড়ই মর্যাদা সম্পন্ন, সুরক্ষিত ও সুদৃঢ় কিতাবে রয়েছে।
মহান আল্লাহ বলেনঃ যারা পূতঃপবিত্র তারা ব্যতীত অন্য কেউ তা স্পর্শ করে না। অর্থাৎ শুধু ফেরেশতারাই এটা স্পর্শ করে থাকেন। হ্যাঁ, তবে দুনিয়ায় এটাকে সবাই স্পর্শ করে সেটা অন্য কথা।
হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর কিরআতে مَايَمُسُّهٗ রয়েছে। হযরত আবুল আলিয়া (রঃ) বলেন যে, এখানে পবিত্র দ্বারা উদ্দেশ্য মানুষ নয়, মানুষ তো পাপী। এটা কাফিরদের জবাবে বলা হয়েছে। তারা বলতো যে, এই কুরআন নিয়ে শয়তান অবতীর্ণ হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তা'আলা অন্য জায়গায় পরিষ্কারভাবে বলেনঃ
وَ مَا تَنَزَّلَتْ بِهِ الشَّیٰطِیْنُ ـ وَ مَا یَنْۢبَغِیْ لَهُمْ وَ مَا یَسْتَطِیْعُوْنَ ـ اِنَّهُمْ عَنِ السَّمْعِ لَمَعْزُوْلُوْنَ
অর্থাৎ “এটা নিয়ে শয়তানরা অবতীর্ণ হয় না, না তাদের এই যোগ্যতা বা শক্তি আছে, এমনকি তাদেরকে তো এটা শ্রবণ হতেও দূর করে দেয়া হয়।” (২৬:২১০-২১২) এ আয়াতের তাফসীরে এ উক্তিটিই মনে বেশী ধরছে। তবে অন্যান্য উক্তিগুলোও এর অনুরূপ হতে পারে। ফারা (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছে এই যে, এর স্বাদ ও মজা শুধুমাত্র ঈমানদার লোকেরাই পেতে পারে। কেউ কেউ বলেন যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো অপবিত্রতা হতে পবিত্র হওয়া। যদিও এটা খবর, কিন্তু উদ্দেশ্য হলো ইনশা। কুরআন দ্বারা এখানে মাসহাফ উদ্দেশ্য। ভাবার্থ হলো এই যে, মুসলমান অপবিত্র অবস্থায় কুরআন কারীমে হাত লাগাবে না। একটি হাদীসে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) কুরআন কারীমকে সাথে নিয়ে হারবী কাফিরদের দেশে যেতে নিষেধ করেছেন। কেননা, হতে পারে যে, শত্রুরা এর কোন ক্ষতি সাধন করবে।” (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আমর ইবনে হাযাম (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (সঃ) যে পত্রটি লিখে দিয়েছিলেন তাতে এও ছিলঃ “পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া যেন কেউ কুরআন স্পর্শ না করে।” (এ হাদীসটি ইমাম মালিক (রঃ) স্বীয় মুআত্তা গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)
মারাসীলে আবি দাউদে রয়েছে যে, যুহরী (রঃ) বলেনঃ “আমি স্বয়ং পত্রটি দেখেছি এবং তাতে এই বাক্যটি পাঠ করেছি।” যদিও এ রিওয়াইয়াতটির বহু সনদ রয়েছে কিন্তু প্রত্যেকটির বিষয়েই চিন্তা-ভাবনার অবকাশ আছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
এরপর ইরশাদ হচ্ছেঃ এই কুরআন কবিতা, যাদু অথবা অন্য কোন বিষয়ের গ্রন্থ নয়, বরং এটা সরাসরি সত্য। কারণ এটা জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট হতে অবতীর্ণ। এটাই সঠিক ও সত্য কিতাব। এটা ছাড়া এর বিরোধী সবই মিথ্যা এবং সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যাত। তবুও কি তোমরা এই বাণীকে তুচ্ছ গণ্য করবে? এর জন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কি এটাই হবে যে, তোমরা একে অবিশ্বাস করবে?
ইযদ গোত্রের ভাষায় رِزْق-এর অর্থ شُكْر বা কৃতজ্ঞতা এসে থাকে। মুসনাদের একটি হাদীসেও رِزْق -এর অর্থ شُكْر করা হয়েছে। অর্থাৎ তোমরা বলে থাকো যে, অমুক তারকার কারণে তোমরা পানি পেয়েছো বা অমুক তারকার কারণে অমুক জিনিস পেয়েছো।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, বৃষ্টির সময় কোন কোন লোক কুফরী কালেমা বলে ফেলে। তারা বলে থাকে যে, বৃষ্টির কারণ হলো অমুক তারকা।
হযরত যায়েদ ইবনে খালিদ জুহনী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমরা হুদায়বিয়ায় অবস্থান করছিলাম, রাত্রে খুব বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছিল। ফজরের নামাযের পর রাসূলুল্লাহ (সঃ) জনগণের দিকে মুখ করে বলেনঃ “আজ রাত্রে তোমাদের প্রতিপালক কি বলেছেন তা তোমরা জান কি?” জনগণ বললেনঃ “আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই (সঃ) ভাল জানেন।” তখন তিনি বললেন, আল্লাহ তা'আলা বলেছেনঃ “আজ আমার বান্দাদের মধ্যে অনেকে কাফির হয়েছে এবং অনেকে মুমিন হয়েছে। যে বলেছে যে, আল্লাহর ফযল ও করমে বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে, সে আমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী এবং তারকাকে অস্বীকারকারী। আর যে বলেছে যে, অমুক অমুক তারকার কারণে বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে, সে আমার সাথে কুফরী করেছে এবং তারকার উপর ঈমান এনেছে।” (এ হাদীসটি ইমাম মালিক (রঃ) স্বীয় মুআত্তা গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম মুসলিমও (রঃ) তাঁর সহীহ গ্রন্থে এটা বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আকাশ হতে যে বরকত নাযিল হয় তা কারো ঈমানের এবং কারো কুফরীর কারণ হয়ে থাকে (শেষ পর্যন্ত)।” (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেছেন) হ্যাঁ, তবে এটা লক্ষ্যণীয় বিষয় যে, একবার হযরত উমার (রাঃ) হযরত আব্বাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ “সুরাইয়া তারকা উদিত হতে কত দিন বাকী আছে?” তারপর তিনি বলেনঃ “জ্যোতির্বিদদের ধারণা এই যে, এই তারকা লুপ্ত হয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহ পর আবার দিগন্তে প্রকাশিত হয়ে থাকে। বাস্তবে এটাই হয় যে, এই প্রশ্নোত্তর ও ইসতিসকার (পানির জন্যে প্রার্থনার) সাত দিন অতিক্রান্ত হতেই বৃষ্টি বর্ষিত হয়। তবে এ ঘটনাটি স্বভাব এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এটা নয় যে, ঐ তারকাকেই তিনি বৃষ্টি বর্ষণের কারণ মনে করতেন। কেননা, এ ধরনের আকীদা তো কুফরী! হ্যাঁ, তবে অভিজ্ঞতাবলে কোন কিছু জেনে নেয়া বা কোন কথা বলে দেয়া অন্য জিনিস। এই ব্যাপারে বহু হাদীস مَا یَفْتَحِ اللّٰهُ لِلنَّاسِ مِنْ رَّحْمَةٍ فَلَا مُمْسِكَ لَهَا অর্থাৎ আল্লাহ মানুষের জন্যে যে রহমত খুলে দেন তা কেউ বন্ধ রাখতে পারে না। (৩৫:২) এই আয়াতের তাফসীরে গত হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি লোককে বলতে শুনেনঃ ‘অমুক তারকার প্রভাবে বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে। তখন তিনি বলেনঃ “তুমি মিথ্যা কথা বলেছে। এ বৃষ্টি তো আল্লাহ তাআলাই বর্ষণ করেছেন! এটা আল্লাহর রিযক।” (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবু উমামা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “যখনই রাত্রে কোন কওমের উপর বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে তখনই সকালে ঐ কওম ওর সাথে কুফরীকারী হয়েছে।” তারপর আল্লাহ তা'আলার নিম্নের উক্তিটি তিনি উদ্ধৃত করেনঃ
وَتَجْعَلُوْنَ رِزْقَكُمْ اَنَّكُمْ تُكَذِّبُوْنَ
অর্থাৎ “তোমরা মিথ্যারোপকেই তোমাদের উপজীব্য করে নিয়েছে।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন যে, তাদের মধ্যে কোন উক্তিকারী উক্তি করেঃ “অমুক অমুক তারকার প্রভাবে আমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে। (এ হাদীসটিও ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে মারফু' রূপে বর্ণিত আছেঃ “সাত বছর পর্যন্ত যদি মানুষ দুর্ভিক্ষের মধ্যে পতিত থাকে, তারপর যদি তাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করা হয়, তবে তখনো তারা বলে বসবে যে, অমুক তারকা বৃষ্টি বর্ষণ করেছে।”
‘তোমরা মিথ্যারোপকেই তোমাদের উপজীব্য করে নিয়েছে। আল্লাহ পাকের এ উক্তি সম্পর্কে মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হলোঃ তোমরা এ কথা বলো না যে, অমুক প্রাচুর্যের কারণ হলো অমুক জিনিস, বরং বললঃ সব কিছুই আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে এসে থাকে। সুতরাং ভাবার্থ এটাও। আবার ভাবার্থ এও হতে পারে যে, কুরআনে তাদের কোনই অংশ নেই, বরং তাদের অংশ এটাই যে, তারা এই কুরআনের উপর মিথ্যারোপ করে থাকে। এই ভাবার্থের পৃষ্ঠপোষকতা করে নিম্নের আয়াতদ্বয়ঃ
اَفَبِهٰذَا الْحَدِیْثِ اَنْتُمْ مُّدْهِنُوْنَ ـ وَ تَجْعَلُوْنَ رِزْقَكُمْ اَنَّكُمْ تُكَذِّبُوْنَ