আত-তাকভীর আয়াত ২৯
وَمَا تَشَاۤءُوْنَ اِلَّآ اَنْ يَّشَاۤءَ اللّٰهُ رَبُّ الْعٰلَمِيْنَ ࣖ ( التكوير: ٢٩ )
Wa maa tashaaa'oona illaaa ai yashaaa 'al laahu Rabbul 'Aalameen (at-Takwīr ৮১:২৯)
English Sahih:
And you do not will except that Allah wills - Lord of the worlds. (At-Takwir [81] : 29)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
তোমরা ইচ্ছে কর না যদি বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ ইচ্ছে না করেন। (আত-তাকভীর [৮১] : ২৯)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
আর বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত তোমরা কোনই ইচ্ছা করতে পার না। [১]
[১] অর্থাৎ, তোমাদের ইচ্ছা আল্লাহর তওফীকের উপর নির্ভরশীল। যতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের ইচ্ছায় আল্লাহ ইচ্ছা এবং তাঁর তওফীক শামিল না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা সরল পথ অবলম্বন করতে পারবে না। এটা সেই বিষয় যা إنك لا تهدي من أحببت অর্থাৎ, 'তুমি যাকে ইচ্ছা কর, তাকে হিদায়াত করতে পার না।'(সূরা ক্বাস্বাস ২৮;৫৬ নং) প্রভৃতি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
আর তোমরা ইচ্ছে করতে পার না, যদি না সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহ্ ইচ্ছে করেন [১]।
[১] অর্থাৎ তোমরা সরল পথে চলতে চাইলে এবং আল্লাহ্র দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে চাইলেই থাকতে পারবে না যতক্ষণ আল্লাহ্ ইচ্ছা না করবেন। সুতরাং তাঁর কাছেই তাওফীক কামনা করো। তবে এটা সত্য যে, কেউ যদি আল্লাহ্র পথে চলতে ইচ্ছে করে তবে আল্লাহ্ও তাকে সেদিকে চলতে সহযোগিতা করেন। মূলত আল্লাহ্র ইচ্ছা হওয়ার পরই বান্দার সে পথে চলার তাওফীক হয়। বান্দার ইচ্ছা আল্লাহ্র ইচ্ছা অনুসারেই হয়। তবে যদি ভাল কাজ হয় তাতে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি থাকে, এটাকে বলা হয় ‘আল্লাহ্র শরীয়তগত ইচ্ছা’ । পক্ষান্তরে খারাপ কাজ হলে আল্লাহ্র ইচ্ছায় সংঘটিত হলেও তাতে তাঁর সন্তুষ্টি থাকে না। এটাকে বলা হয় ‘আল্লাহর প্রাকৃতিক ইচ্ছা’ । এ দু' ধরনের ইচ্ছার মধ্যে পার্থক্য না করার কারণে অতীতে ও বর্তমানে অনেক দল ও ফের্কার উদ্ভব ঘটেছে। [দেখুন, ইবন তাইমিয়্যাহ, আল-ইস্তেকামাহ; ১/৪৩৩; মিনহাজুস সুন্নাহ; ৩/১৬৪]
3 Tafsir Bayaan Foundation
আর তোমরা ইচ্ছা করতে পার না, যদি না সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহ ইচ্ছা করেন।
4 Muhiuddin Khan
তোমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অভিপ্রায়ের বাইরে অন্য কিছুই ইচ্ছা করতে পার না।
5 Zohurul Hoque
আর বিশ্বজগতের প্রভু আল্লাহ্ যা চান তা ব্যতীত তোমরা অন্য কোনো-কিছু চাইবে না।
6 Mufti Taqi Usmani
তোমরা ইচ্ছা করবে না, যদি না আল্লাহ ইচ্ছা করেন, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।
7 Mujibur Rahman
তোমরা ইচ্ছা করবেনা, যদি জগতসমূহের রাব্ব আল্লাহ ইচ্ছা না করেন।
8 Tafsir Fathul Mazid
১৫-২৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর:
অত্র আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা কয়েকটি বস্তুর শপথ করে বলছেন যে, কুরআন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে জিবরীল (আঃ)-এর আনীত বাণী কোন শয়তানের বাণী নয়।
الْـخُنَّسِ শব্দটি বহুবচন, একবচন হল خانس و خانسة অর্থ যখন পিছিয়ে গেল, হারিয়ে গেল। الْـخُنَّسِ বলা হয়, সাতটি চলমান তারকা যা পূর্বাকাশে বিলম্বে অস্ত যায়। সে সাতটি হলো সূর্য, চন্দ্র, জাহরাহ, মুশতারি, মিরইয়াঝ, জাহাল ও আতারিদ। এ সাতটি তারকার চলার দু’টি পথ:
১. পশ্চিম দিকের পথ যে পথে সকল তারকা চলে।
২. পূর্ব দিকে উল্টোভাবে।
الْـجَوَارِ বহুবচন, একবচন হল جَارية, অর্থ সন্তরণশীল।
الْكُنَّسِ অর্থ : লুকিয়ে যাওয়া। আলী (রাঃ) বলেন : এগুলি হল ঐসব তারকা, যা দিনের বেলায় লুকিয়ে থাকে ও রাতের বেলায় প্রকাশিত হয় (কুরতুবী)। বিজ্ঞানীরা এখান থেকে “ব্লাক হোল” এর তথ্য প্রমাণ করেছেন।
عَسْعَسَ শব্দটি বিপরীতার্থক শব্দ। অর্থাৎ যখন রাত্রি আগমন করে এবং বিদায় নেয়।
تَنَفَّسَ এর আসল অর্থ হলো পেট থেকে শ্বাস বের হওয়া (কুরতুবী)। রাতের অন্ধাকার ভেদ করে সূর্যের আলো বেরিয়ে আসে এ কথাটি ফুটিয়ে তোলার জন্য এখানে تَنَفَّسَ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ যখন সকাল প্রকাশ পায় ও উদয় হয় অথবা উজ্জ্বল হয়ে বের হয়ে আসে। এসব উল্লিখিত শপথসমূহের জবাব হলো যে, নিশ্চয়ই এ কুরআন সম্মানিত জিবরীল (আঃ)-এর আনীত বাণী। নাবী মুহাম্মাদ, ফেরেশতা বা কোন শয়তানের কথা নয় যা মক্কার মুশরিকরা দাবী করে থাকে। পরের দু আয়াতে জিবরীল (আঃ)-এর চারটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে।
(ذِيْ قُوَّةٍ) ‘সে শক্তিশালী’ অর্থাৎ জিরবীল (আঃ) এত শক্তিশালী যে ওয়াহী নিয়ে আসার সময় শয়তান তার কাছে ভিড়তে পারে না। দুনিয়াতে জিবরীল (আঃ)-এর শক্তিমত্তার বহু প্রমাণ রয়েছে। যেমন লূত (আঃ)-এর জাতিকে ভূমি ও নগরীসহ চোখের পলকে উৎপাটিত করে ফেলা এলাকা এখন মৃত সাগর নামে পরিচিত। নাবী (সাঃ)-কে যখন তায়েফবাসীরা আঘাত করল তখন জিবরীল বলল: হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমাকে বলুন আমি এদেরকে দু পাহাড় একত্রিত করে পিষে মেরে ফেলি। (সহীহ বুখারী, কিতাবু বাদইল খালক) জিরবীল (আঃ)-এর কাছ থেকে ওয়াহী ছিনিয়ে নেয়ার মত কোন শক্তি নেই এবং তিনি কোন প্রকার খেয়ানত করেননি।
(عِنْدَ ذِي الْعَرْشِ مَكِيْنٍ)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার নিকট তার অনেক মর্যাদা রয়েছে।
(مُّطَاعٍ ثَمَّ أَمِيْنٍ)
অর্থাৎ জিবরীল (আঃ) ঊর্ধ্বজগতে আনুগত্যপ্রাপ্ত। তিনি সাধারণ ফেরেশতা নন বরং ফেরেশতাদের সর্দার এবং তিনি ওয়াহীর ক্ষেত্রেও আমানতদার। তাতে তিনি কম-বেশি করেননি এবং যা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তার লংঘন করেননি। তাই যেসব শিয়া বলে থাকে, জিবরীল (আঃ) খেয়ানত করত ওয়াহী আলী (রাঃ)-এর কাছে না নিয়ে এসে মুহাম্মাদের কাছে এসেছেÑতাদের এ দাবী মিথ্যা। কারণ তিনি খেয়ানত করে এরূপ করলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে “আমীন” বলে আখ্যায়িত করতেন না।
(وَمَا صَاحِبُكُمْ....)
দ্বারা উদ্দেশ্য নাবী (সাঃ)। আর সম্বোধন হলো মক্কাবাসীদেরকে। নাবী (সাঃ) صَاحِبُ বা সাথী বলার কারণ হলো মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে তাদের সাথেই ছোট থেকে বড় হতে দেখেছে, একই সমাজে লালিত-পালিত হয়েছেন।
(وَلَقَدْ رَاٰهُ بِالْأُفُقِ....)
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জিবরীল (আঃ)-কে তার নিজস্ব আকৃতিতে দেখেছেন। তাই জিবরীল (আঃ) তাঁর কাছে পরিচিত, একমাত্র তিনিই নাবী (সাঃ)-এর কাছে ওয়াহী নিয়ে আসতেন। এ সম্পর্কে সূরা নাজমের শুরুতে আলোচনা করা হয়েছে।
(وَمَا هُوَ عَلَي الْغَيْبِ بِضَنِيْنٍ)
অর্থাৎ মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর ওপর যা কিছু অবতীর্ণ হয়েছে সে বিষয়ে তিনি কৃপণ নন যে, তিনি কিছু তা হতে গোপন করবেন। বরং তিনি আকাশবাসী ও জমিনবাসী সকলের নিকট আমানতদার। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَوْ تَقَوَّلَ عَلَيْنَا بَعْضَ الْأَقَاوِيْلِ لا لَاَخَذْنَا مِنْهُ بِالْيَمِيْنِ ثُمَّ لَقَطَعْنَا مِنْهُ الْوَتِيْنَ)
“যদি সে নিজে কোন কথা বানিয়ে আমার কথা বলে চালিয়ে দিত, তবে অবশ্যই আমি তার ডান হাত ধরে ফেলতাম, এবং কেটে দিতাম তার হৃৎপিণ্ডের শিরা।” (সূরা হাককাহ ৬৯: ৪৪-৪৬)
(وَمَا هُوَ بِقَوْلِ شَيْطَانٍ رَّجِيْمٍ)
অর্থাৎ যেমন শয়তান আসমানের কিছু সংবাদ চুরি করে শোনে অতঃপর তা অসম্পূর্ণভাবে জ্যোতিষীকে বলে দেয়। কুরআন এরূপ না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَا تَنَزَّلَتْ بِهِ الشَّيٰطِيْنُ ج ومَا يَنـبَغِيْ لَهُمْ وَمَا يَسْتَطِيْعُوْنَ إِنَّهُمْ عَنِ السَّمْعِ لَمَعْزُوْلُوْنَ)
“শয়তানরা (এ কুরআন) তা-সহ অবতীর্ণ হয়নি। তারা এ কাজের যোগ্য নয় এবং তারা এটার সামর্থ্যও রাখে না। তাদেরকে (ওয়াহী) শ্রবণের সুযোগ হতে দূরে রাখা হয়েছে।” (সূরা শুআরা ২৬: ২১০)
সুতরাং যারা নাবী (সাঃ)-কে গণক জ্যোতিষী বলে থাকে তাদের দাবীও খণ্ডন করা হয়েছে।
(فَأَيْنَ تَذْهَبُوْنَ)
অর্থাৎ যে কুরআন একজন আমানতদার ফেরেশতা একজন আমানতদার ব্যক্তির কাছে নিয়ে আসলেন যাতে শয়তানের হস্তক্ষেপের কোন অবকাশ নেই তারপরেও তোমরা কিভাবে এ কুরআনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করছো? কেন তা হতে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ ? আর কেন তাঁর আনুগত্য কর না?
(ذِكْرٌ لِّلْعٰلَمِيْنَ)
অর্থাৎ এ কুরআন বিশ্ববাসীর জন্য উপদেশ। যারা হিদায়াত গ্রহণ করতে চায় তাদের জন্য পথপ্রদর্শকÑ যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنَّ هٰذِه۪ تَذْكِرَةٌ ج فَمَنْ شَا۬ءَ اتَّخَذَ إِلٰي رَبِّه۪ سَبِيْلًا)
“এটা এক উপদেশবাণী, অতএব যার ইচ্ছা সে তার প্রতিপালকের দিকে যাওয়ার পথ অবলম্বন করুক।” (সূরা দাহর ৭৬: ২৯)
(وَمَا تَشَا۬ءُوْنَ إِلَّآ أَنْ يَّشَا۬ءَ اللّٰهُ)
অর্থাৎ চাওয়া পাওয়া শুধু তোমাদের দিকে সোপর্দ করে দেয়া হয়নি। বরং তোমাদের চাওয়া-পাওয়া আল্লাহ তা‘আলার চাওয়ার উপর নির্ভরশীল। আল্লাহ তা‘আলা যাকে চান ও ভালবাসেন তাকে হিদায়াত দান করেন আর যাকে চান না ও ভালবাসেন না তাকে হিদায়াত দেন না। সুলাইমান বিন মূসা (রহঃ) বলেন : যখন
(لِمَنْ شَا۬ءَ مِنْكُمْ أَنْ يَّسْتَقِيْمَ)
আয়াতটি অবতীর্ণ হলো তখন আবূ জাহল বলল : সঠিক পথে বহাল থাকা আর না থাকা আমাদের হাতে আমরা ইচ্ছা করলে থাকতেও পারি নাও পারি। তখন
(وَمَا تَشَا۬ءُوْنَ إِلَّآ أَنْ يَّشَا۬ءَ اللّٰهُ)
অবতীর্ণ হয়। (ইবনু কাসীর)। তাই ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন : আবূ জাহল হল তাকদীর অস্বীকারকারী কাদরীয়াদের নেতা। আল্লাহ তা‘আলার মাশিয়াত বা ইচ্ছা এবং এ সম্পর্কে আহলুস সুন্নাহর অবস্থান সম্পর্কে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
কুরআন আল্লাহ তা‘আলার বাণী, একজন আমানতদার ফেরেশতা আমানতদার রাসূলের নিকট নিয়ে এসেছেন। তাই কুরআন যা নির্দেশ করে তা সত্য এবং বাস্তবসম্মত।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. জিবরীল (আঃ)-এর বৈশিষ্ট্যের কথা জানতে পারলাম।
২. কুরআন আল্লাহ তা‘আলার বাণী, কোন বিতাড়িত শয়তান, গণক বা জ্যোতিষীর কথা নয়।
৩. মানুষের ইচ্ছা আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছাধীন। মানুষ ইচ্ছা করলেই সব করতে পারে না, যদি আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা না করেন।
9 Fozlur Rahman
আর বিশ্বজগতের প্রভু আল্লাহ না চাইলে তোমরা (কিছু) চাইতে পার না।
10 Mokhtasar Bangla
২৯. তোমরা সরল পথে চলা কিংবা না চলা কোনটারই ইচ্ছা করতে পারো না যদি সকল সৃষ্টির প্রতিপালক তা না চান।
11 Tafsir Ibn Kathir
হযরত আমর ইবনে হুইস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমি নবী (সঃ)-এর পিছনে ফজরের নামায পড়েছি এবং তাঁকে ঐ নামাযে فَلَاۤ اُقْسِمُ بِالْخُنَّسِ ـ الْجَوَارِ الْكُنَّسِ ـ وَ الَّیْلِ اِذَا عَسْعَسَ ـ وَ الصُّبْحِ اِذَا تَنَفَّسَএই আয়াতগুলো পড়তে শুনেছি।” (এ হাদীসটি ইমাম মুহাম্মাদ (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
এখানে নক্ষত্ররাজির শপথ করা হয়েছে যেগুলো দিনের বেলায় পিছনে সরে যায় অর্থাৎ লুকিয়ে যায় এবং রাতের বেলায় আত্মপ্রকাশ করে। হযরত আলী (রাঃ) এ কথাই বলেন। অন্যান্য সাহাবী ও তাবেয়ীগণ হতেও এ আয়াতের তাফসীরে এটাই বর্ণিত হয়েছে।
কোন কোন ইমাম বলেন যে, উদয়ের সময় নক্ষত্রগুলোকে خُنَّس বলা হয়। আর স্ব স্ব স্থানে ওগুলোকে جَوَار বলা হয় এবং লুকিয়ে যাওয়ার সময় كُنَّس বলা হয়। কেউ কেউ বলেন যে, এর দ্বারা বন্য গাভীকে বুঝানো হয়েছে। এও বর্ণিত আছে যে, এর দ্বারা হরিণ উদ্দেশ্য।
ইবরাহীম (রঃ) হযরত মুজাহিদ (রঃ)-কে এর অর্থ জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তরে বলেনঃ “এ সম্পর্কে আমি কিছু শুনেছি। তবে লোকে বলে যে, এর দ্বারা নক্ষত্রকে বুঝানো হয়েছে।” ইবরাহীম (রঃ) পুনরায় তাকে বলেনঃ “আপনি যা শুনেছেন তাই বলুন।” তখন হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেনঃ “আমি শুনেছি যে, এর অর্থ হলো নীল গাভী, যখন সে নিজের জায়গায় লুকিয়ে যায়।” অতঃপর ইবরাহীম (রঃ) বলেনঃ “তারা আমার উপর এ ব্যাপারে মিথ্যা আরোপ করেছে, যেমন তারা হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছে যে, তিনি আসফালকে আ’লার এবং আ’লাকে আসফালের যামিন বানিয়েছেন। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এর মধ্যে কোন কিছু নির্দিষ্ট না করে বলেছেন যে, সম্ভবতঃ এখানে তিনটি জিনিসকেই বুঝানো হয়েছে অর্থাৎ নক্ষত্র, নীল গাভী এবং হরিণ।
وَالَّيْلِ اِذَا عَسْعَسَ এতে দু’টি উক্তি রয়েছে। একটি উক্তি এই যে, এর অর্থ হলোঃ শপথ রাত্রির, যখন ওটা স্বীয় অন্ধকারসহ এগিয়ে আসে। আর দ্বিতীয় উক্তি এই যে, এর অর্থ হলোঃ শপথ রাত্রির যখন ওটা পিছনে সরে যায় অর্থাৎ যখন র অবসান হয়।
হযরত আবু আবদির রহমান সালমী (রাঃ) বলেন যে, একদা হযরত আলী (রাঃ) ফজরের নামাযের সময় বের হন এবং বলতে থাকেনঃ “বের (এর নামায) সম্পর্কে প্রশ্নকারীরা কোথায়?” অতঃপর তিনি وَالَّيْلِ اِذَا عَسْعَسَ ـ وَالصُّبْحِ اِذَا تَنَفَّسَ-এ আয়াত দু’টি পাঠ করেন। অর্থাৎ “রাত্রির শপথ, যখন ওর অবসান হয় এবং ঊষার শপথ, যখন ওর আবির্ভাব হয়। (এটা আবু দাউদ তায়ালেসী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এটাই পছন্দ করেছেন যে, وَالَّيْلِ اِذَا عَسْعَسَ-এর অর্থ হলোঃ শপথ রাত্রির, যখন ওটা চলে যেতে থাকে। কেননা, এর বিপরীতে রয়েছেঃ وَالصُّبْحِ اِذَا تَنَفَّسَ অর্থাৎ ঊষার শপথ যখন ওর আবির্ভাব হয়। عَسْعَسَ-এর অর্থ اِدْبَار বা পিছনে সরে যাওয়া অর্থাৎ বিদায় নেয়া, তার স্বপক্ষে কবির উক্তিকেই দলীল হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন কোন এক কবি বলেছেনঃ
حَتّٰى اِذَا الصُّبْحُ لَهٗ تَنَفّسا ـ وَانْجَابَ عَنْهَا لَيْلَهَا وَعَسْعَسَا
অর্থাৎ “শেষ পর্যন্ত ঊষা আবির্ভূত হলো এবং তা হতে রাত্রির অন্ধকার দূরীভূত হলে ও ওর অবসান হয়ে গেল।” এখানে, عَسْعَسَ শব্দকে اِدْبَار বা পিছনে সরে যাওয়া অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।
আমার মতে اِذَا عَسْعَسَ এর অর্থ হবেঃ যখন ওর আবির্ভাব হয়। যদিও ادبار অর্থেও এটাকে ব্যবহার করা শুদ্ধ। কিন্তু এখানে এ শব্দকে اِقْبَال-এর অর্থে ব্যবহার করাই হবে বেশী যুক্তিযুক্ত। আল্লাহ্ তা'আলা যেন রাত্রি এবং ওর অন্ধকারের শপথ করেছেন যখন ওটা এগিয়ে আসে বা যখন ওটা আবির্ভূত হয়। আর তিনি শপথ করেছেন ঊষার এবং ওর আলোকের যখন ওটা আবির্ভূত হয় বা যখন ওর ঔজ্জ্বল্য প্রকাশ পায়। যেমন তিনি বলেনঃ
وَاللَّيْلِ اِذَا يَغْشٰى ـ وَالنَّهَارِ اِذَا تَجَلّٰى
অর্থাৎ “শপথ রজনীর, যখন ওটা আচ্ছন্ন করে এবং শপথ দিবসের, যখন ওটা আবির্ভূত হয়।' আরও বলেনঃ
وَالضُّحٰى ـ وَالَّيْلِ اِذَا سَجٰى
অর্থাৎ “শপথ পূর্বাহ্নের, শপথ রজনীর যখন ওটা হয় নিঝুম।” আর এক জায়গায় বলেনঃ
فَالِقُ الْاِصْبَاحِ وَ جَعَلَ الَّیْلَ سَكَنًا
অর্থাৎ “তিনি সকাল বিদীর্ণকারী ও তিনি রাত্রিকে করেছেন বিশ্রামের সময়।” (৬:৯৬) এ ধরনের আরো বহু আয়াত রয়েছে। সবগুলোরই ভাবার্থ একই। হ্যা, তবে এ শব্দের একটা অর্থ পশ্চাদপসরণও রয়েছে। উসূলের পণ্ডিতগণ বলেন যে, এ শব্দটি সামনে অগ্রসর হওয়া এবং পিছনে সরে আসা এই উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়। এরই প্রেক্ষিতে উভয় অর্থই যথার্থ হতে পারে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ্ তা'আলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
এরপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ সকালের শপথ যখন ওর আবির্ভাব হয়। যহহাক (রঃ) বলেন যে, এর অর্থ হলোঃ যখন সকাল প্রকাশিত হয়। কাতাদাহ (রঃ) বলেন যে, এর অর্থ হচ্ছেঃ যখন সকাল আলোকিত হয় এবং এগিয়ে আসে। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, এর অর্থ হলোঃ দিনের আলো, যখন তা এগিয়ে আসে এবং প্রকাশিত হয়।
এই শপথের পর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ এই কুরআন এক বুযুর্গ, অভিজাত, পবিত্র ও সুদর্শন ফেরেশতার মাধ্যমে প্রেরিত অর্থাৎ জিবরাঈল (আঃ)-এর মাধ্যমে প্রেরিত। এই ফেরেশতা সামর্থ্যশালী। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ
عَلَّمَهٗ شَدِیْدُ الْقُوٰى ـ ذُوْ مِرَّةٍ
অর্থাৎ “তাকে শিক্ষা দান করে শক্তিশালী, প্রজ্ঞাসম্পন্ন ফেরেশতা (জিবরাঈল আঃ)।” (৫৩:৫-৬)
ঐ ফেরেশতা আরশের মালিকের নিকট মর্যাদা সম্পন্ন। তিনি নূরের সত্তরটি পর্দার অভ্যন্তরে যেতে পারেন, তার জন্যে এর সাধারণ অনুমতি রয়েছে। সেখানে তার কথা শোনা যায়। বহু সংখ্যক ফেরেশতা তার অনুগত রয়েছেন। আকাশে তার নেতৃত্ব রয়েছে। তাঁর আদেশ পালন ও তাঁর কথা মান্য করার জন্য বহু সংখ্যক ফেরেশতা রয়েছেন। আল্লাহ্র পয়গাম তাঁর রাসূল (সঃ)-এর নিকট পৌছানোর দায়িত্বে তিনি নিয়োজিত রয়েছেন। তিনি বড়ই বিশ্বাস ভাজন। মানুষের মধ্যে যিনি রাসূল হিসেবে মনোনীত হয়েছেন তিনিও পাক-সাফ ও পবিত্র। এ কারণেই এরপর বলা হয়েছেঃ তোমাদের সাথী অর্থাৎ হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) উন্মাদ বা পাগল নন। তাঁর মস্তিষ্ক-বিকৃতি ঘটেনি। তিনি জিবরাঈল আমীন (আঃ)-কে তাঁর আসল আকৃতিতে ছয় শত পাখা সমেত আত্মপ্রকাশের সময়ে প্রত্যক্ষ করেছেন। এটা বাতহার (মক্কার এক উপত্যকার) ঘটনা। ওটাই ছিল হযরত জিবরাঈল (আঃ)-কে আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর প্রথম দর্শন। আকাশের উন্মুক্ত প্রান্তে হযরত জিবরাঈল (আঃ)-এর এই দর্শন আল্লাহর নবী (সঃ) লাভ করেছিলেন। নিম্নের আয়াতগুলোতে আল্লাহ্ তা'আলা তারই বর্ণনা দিয়েছেনঃ
عَلَّمَهٗ شَدِیْدُ الْقُوٰى ـ ذُوْ مِرَّةٍ فَاسْتَوٰى ـ وَ هُوَ بِالْاُفُقِ الْاَعْلٰى ـ ثُمَّ دَنَا فَتَدَلّٰى ـ فَكَانَ قَابَ قَوْسَیْنِ اَوْ اَدْنٰى ـ فَاَوْحٰۤى اِلٰى عَبْدِهٖ مَاۤ اَوْحٰى
অর্থাৎ “তাকে শিক্ষাদান করে শক্তিশালী, প্রজ্ঞাসম্পন্ন, সে নিজ আকৃতিতে স্থির হয়েছিল, তখন সে ঊধ্বদিগন্তে। অতঃপর সে তার নিকটবর্তী হলো, অতি নিকটবর্তী। ফলে তাদের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান রইলো অথবা তারও কম।। তখন আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি যা ওয়াহী করবার তা অহী করলেন।” (৫৩:৫-১০) এ আয়াতগুলোর তাফসীর সূরা নাজমের মধ্যে গত হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় যে, এই সূরা মি'রাজের পূর্বে অবতীর্ণ হয়েছে। কারণ এখানে শুধু প্রথমবারের দেখার কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয়বারের দেখার কথা নিম্নের আয়াতগুলোতে বর্ণনা করা হয়েছেঃ
وَ لَقَدْ رَاٰهُ نَزْلَةً اُخْرٰى ـ عِنْدَ سِدْرَةِ الْمُنْتَهٰى ـ عِنْدَهَا جَنَّةُ الْمَاْوٰى ـ اِذْ یَغْشَى السِّدْرَةَ مَا یَغْشٰى
অর্থাৎ “নিশ্চয়ই সে তাকে আরেকবার দেখেছিল প্রান্তবর্তী বদরী বৃক্ষের নিকট, যার নিকট অবস্থিত বাসোদ্যান। যখন বৃক্ষটি, যদ্দ্বারা আচ্ছাদিত হবার তদ্দ্বারা ছিল আচ্ছাদিত।” (৫৩:১৩-১৬) এখানে দ্বিতীয়বার দেখার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এই সূরা মিরাজের পরে অবতীর্ণ হয়েছে بِضَنِيْن অন্য কিরআতে بِظَنِيْن রয়েছে, অর্থাৎ তার প্রতি কোন অপবাদ নেই। আর ضَاد দিয়ে পড়লে অর্থ হবেঃ তিনি কৃপণ বা বখীল নন, বরং আল্লাহ্র পক্ষ থেকে কোন গায়েবের কথা তাঁকে অবহিত করা হলে তিনি তা যথাযথভাবে পৌছিয়ে দেন। এই দুটি কিরাআতই বিশুদ্ধ ও সুপ্রসিদ্ধ। সুতরাং জিবরাঈল (আঃ) বার্তাবহ হিসেবে বার্তা পৌঁছাতে কোন প্রকার ঘাটতি রাখেননি বা কোন প্রকারের অপবাদও আরোপ করেননি।
এই কুরআন অভিশপ্ত শয়তানের বাণী নয়। শয়তান এটা ধারণ করতে পারে না। এটা তার দাবী বা চাহিদার বস্তুও নয় এবং সে এর যোগ্যও নয়। যেমন আল্লাহ তা'আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ
وَ مَا تَنَزَّلَتْ بِهِ الشَّیٰطِیْنُ ـ وَ مَا یَنْۢبَغِیْ لَهُمْ وَ مَا یَسْتَطِیْعُوْنَ ـ اِنَّهُمْ عَنِ السَّمْعِ لَمَعْزُوْلُوْنَ
অর্থাৎ “এই কুরআন নিয়ে শয়তানরা অবতীর্ণ হয় নাই, এটা তাদের জন্যে সমীচিনও নয় এবং এটা বহন করার তাদের শক্তিও নেই। তাদেরকে তো এটা শ্রবণ করা হতেও দূরে রাখা রয়েছে।” (২৬:২১০-২১২) এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ সুতরাং তোমরা কোথায় চলেছো? অর্থাৎ কুরআনের সত্যতা, বাস্তবতা ও অলৌকিকতা প্রকাশিত হওয়ার পরও তোমরা এটাকে মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করছো কেন? তোমাদের বিবেক-বুদ্ধি কোথায় গেল?
হযরত আবুবকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর কাছে বানু হানীফা গোত্রের লোকেরা মুসলমান হয়ে হাযির হলে তিনি তাদেরকে বলেনঃ “ যে মুসাইলামা নবুওয়াতের মিথ্যা দাবী করেছে এবং যাকে তোমরা আজ পর্যন্ত মানতে রয়েছে, তার মনগড়া কথাগুলো শুনাও তো?” তারা তা শুনালে দেখা গেল যে, তা অত্যন্ত বাজে শব্দে ফালতু বকবকানি ছাড়া কিছুই নয়। হযরত আবু বকর (রাঃ) তখন তাদেরকে বললেনঃ “তোমাদের বিবেক-বুদ্ধি কি একেবারে লোপ পেয়ে গেছে? বাজে বকবকানিকে তোমরা আল্লাহর বাণী বলে মান্য করছো? এ ধরনের অর্থহীন ও লালিত্যহীন কথনও কি আল্লাহ্র বাণী হতে পারে? এটা তো সম্পূর্ণ অসম্ভব ব্যাপার।
এ অর্থও করা হয়েছেঃ তোমরা আল্লাহর কিতাব থেকে এবং তাঁর আনুগত্য থেকে কোথায় পলায়ন করছো?
এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ এটা তো শুধু বিশ্ব জগতের জন্যে উপদেশ এবং নসীহত স্বরূপ। হিদায়াত প্রত্যাশী প্রত্যেক মানুষের উচিত এই কুরআনের উপর আমল করা। এই কুরআন সঠিক পথ-প্রদর্শক এবং মুক্তির সনদ। এই বাণী ছাড়া অন্য কোন বাণীতে মুক্তি বা পথনির্দেশ নেই। তোমরা যাকে ইচ্ছা হিদায়াত করতে পার না এবং যাকে ইচ্ছা গুমরাহ্ বা পথভ্রষ্টও করতে পার না। এটা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্ তা'আলার ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। তিনি সারা বিশ্বের স্রষ্টা ও প্রতিপালক। তিনি যা ইচ্ছা করেন তাই করে থাকেন। তাঁর ইচ্ছাই সর্বক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হয় এবং পূর্ণতা লাভ করে।
لِمَنْ شَآءَ مِنْكُمْ اَنْ يَسْتَقِيْمَ-এই আয়াত শুনে আবু জাহল বলেঃ “তাহলে তো হিদায়াত ও গুমরাহী আমাদের আয়ত্ত্বাধীন ব্যাপার। তার এ কথার জবাবে আল্লাহ্ তা'আলা নিম্নের আয়াত অবতীর্ণ করেনঃ وَ مَا تَشَآءُوْنَ اِلَّاۤ اَنْ یَّشَآءَ اللّٰهُ رَبُّ الْعٰلَمِیْنَ অর্থাৎ “তোমরা ইচ্ছা করবে না, যদি জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ্ ইচ্ছা করেন।”