আল ক্বামার আয়াত ৫
حِكْمَةٌ ۢ بَالِغَةٌ فَمَا تُغْنِ النُّذُرُۙ ( القمر: ٥ )
Hikmatum baalighatun famaa tughnin nuzur (al-Q̈amar ৫৪:৫)
English Sahih:
Extensive wisdom – but warning does not avail [them]. (Al-Qamar [54] : 5)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
তা (হল) সুদূর প্রসারী জ্ঞান, কিন্তু সেই সতর্কবাণী কোন কাজে আসেনি। (আল ক্বামার [৫৪] : ৫)
1 Tafsir Ahsanul Bayaan
এটা পরিপূর্ণ জ্ঞানগর্ভ বাণী,[১] তবে এই সতর্কবাণীসমূহ তাদের কোন উপকারে আসেনি। [২]
[১] অর্থাৎ, এমন বাণী, যা ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষাকারী। অথবা এই কুরআন সম্পূর্ণ বিজ্ঞানময়। তাতে কোন খুঁত বা ত্রুটি নেই। অথবা মহান আল্লাহ যাকে চান, হিদায়াত দেন এবং যাকে চান, পথভ্রষ্ট করেন, তাতেও যে বড় কৌশল নিহিত আছে সে কথা কেবল তিনিই জানেন।
[২] অর্থাৎ, যার জন্য আল্লাহ পাক দুর্ভাগ্য লিখে দিয়েছেন এবং যার অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছেন নবীদের ভীতিপ্রদর্শন আর কি তার উপকারে আসতে পারে? তার জন্য তো {سَوَاءٌ عَلَيْهِمْ أَأَنذَرْتَهُمْ أَمْ لَمْ تُنذِرْهُم} কথাই প্রযোজ্য। নিম্নের আয়াতটিও প্রায় অনুরূপ অর্থেরইঃ {قُلْ فَلِلّٰهِ الْحُجَّةُ الْبَالِغَةُ فَلَوْ شَاء لَهَدَاكُمْ أَجْمَعِينَ} (তুমি বলে দাও! অতঃপর চূড়ান্ত প্রমাণ তো আল্লাহরই। তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদের সবাইকে পথ প্রদর্শন করতেন। (সূরা আনআম ৬;১৪৯ আয়াত)
2 Tafsir Abu Bakr Zakaria
এটা পরিপূর্ণ হিকমত, কিন্তু ভীতিপ্রদর্শন তাদের কোন কাজে লাগেনি।
3 Tafsir Bayaan Foundation
পরিপূর্ণ হিকমাত। তবে সতর্কবাণী তাদের কোন উপকারে আসেনি।
4 Muhiuddin Khan
এটা পরিপূর্ণ জ্ঞান, তবে সতর্ককারীগণ তাদের কোন উপকারে আসে না।
5 Zohurul Hoque
এক সুপরিণত জ্ঞান, কিন্তু এ সতর্কীকরণ কোনো কাজে আসে না।
6 Mufti Taqi Usmani
এমন জ্ঞানগর্ভ কথা, যা হৃদয়ে পৌঁছে যায়। তা সত্ত্বেও সতর্কবাণীসমূহ তাদের কোন কাজে আসেনি।
7 Mujibur Rahman
এটা পরিপূর্ণ জ্ঞান, তবে এই সতর্ক বাণী তাদের কোন উপকারে আসেনি।
8 Tafsir Fathul Mazid
নামকরণ ও আলোচ্য বিষয় :
الْقَمَرُ ‘ক্বামার’ শব্দের অর্থ চন্দ্র, চাঁদ। সূরার প্রথম আয়াতে الْقَمَرُ শব্দটি উল্লেখ আছে, এখান থেকেই এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে। পূর্বের সূরায় শেষের দিকে
(اَزِفَتِ الْاٰزِفَةُ)
বলা হয়েছে, যাতে কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। আলোচ্য সূরাকে এ বিষয়বস্তু দ্বারাই অর্থাৎ
(اِقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ)
‘কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে’ বলে শুরু করা হয়েছে। এরপর কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার একটি দলীল আনা হয়েছে। কেননা চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়া কিয়ামতের অন্যতম একটি আলামত। কিয়ামতের বিপুল সংখ্যক আলামতের মধ্যে সর্ববৃহৎ আলামত হচ্ছে শেষ নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আগমন। হাদীসে এসেছে নাবী বলেন : আমার আগমন ও কিয়ামত সংঘটিত হওয়া হাতের দুই আঙ্গুলের ন্যায় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। (সহীহ বুখারী হা. ৫৩০১)
১-৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
শানে নুযুল :
ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে মক্কা থেকে বের করে দেয়ার পূর্বে মক্কায় চাঁদকে দু’খণ্ডে বিভক্ত অবস্থায় দেখেছি। মক্কাবাসী বলছিল : চাঁদকে জাদুগ্রস্থ করা হয়েছে তখন
(اِقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانْشَقَّ الْقَمَرُ)
আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (সহীহ বুখারী হা. ৩৬৩৬)
আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : মক্কাবাসী নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট একটি (নবুওয়াতের প্রমাণস্বরূপ) নিদর্শন চাইল। ফলে মক্কায় দু’বার চাঁদ বিদীর্ণ হয়। তখন এ আয়াত অবতীর্ণ হয়। (সহীহ মুসলিম হা. ২৮০২, সহীহ বুখারী হা. ৪৭৬৭, তিরমিযী হা. ৩৬৩৭)
প্রথম আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামত অতি নিকটবর্তী সে সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন।
এ সম্পর্কে অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(أَتٰٓي أَمْرُ اللّٰهِ فَلَا تَسْتَعْجِلُوْهُ ط سُبْحٰنَه۫ وَتَعَالٰي عَمَّا يُشْرِكُوْنَ)
“আল্লাহর আদেশ আসবেই; সুতরাং এর জন্য তাড়াহুড়া কর না। তিনি মহিমান্বিত এবং তারা যাকে শরীক করে তিনি তার ঊর্ধ্বে।” (সূরা আন্ নাহ্ল ১৬ : ১) অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(اِقْتَرَبَ لِلنَّاسِ حِسَابُهُمْ وَهُمْ فِيْ غَفْلَةٍ مُّعْرِضُوْنَ)
“মানুষের হিসাব-নিকাশের সময় আসন্ন, কিন্তু তারা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে রয়েছে।” (সূরা আম্বিয়া- ২১ : ১)
আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন : একদা আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদের সামনে ভাষণ দান করেন। ঐ সময় সূর্য অস্তমিত হতে অতি অল্প সময় বাকী ছিল। ভাষণে তিনি বলেন : যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ! অতীত যুগের তুলনায় দুনিয়ার হায়াতও এ পরিমাণ বাকী আছে যে পরিমান সময় এ দিনের বাকী আছে গত হয়ে যাওয়া সময়ের তুলনায়। আর আমি সূর্যের সামান্য অংশই দেখতে পাচ্ছি। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ ১০/ ৩১১, বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য)
ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : একদা ‘আসরের পর যখন সূর্য ডুবুডুবু অবস্থা, এমন সময় আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে বসেছিলাম। তখন তিনি বললেন : অতীত যুগের লোকদের বয়সের তুলনায় তোমাদের বয়স ততটুকু যতটুকু সময় বাকী আছে এ দিনের। (আহমাদ ২/১১৫, ১১৬, সহীহ)
(وَانْشَقَّ الْقَمَرُ)
‘চন্দ্র বিদীর্ণ হয়ে গেছে’ চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার ঘটনা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবদ্দশায় হয়েছিল। এটি সে মু‘জিযাহ, যা মক্কাবাসীদের দাবী অনুযায়ী দেখানো হয়েছিল। চাঁদ দু’টুকরো হয়ে গিয়েছিল। এমনকি লোকেরা তার (দুখণ্ড চাঁদের) মাঝ দিয়ে হিরা পাহাড়কে দেখতে পায়। অর্থাৎ চাঁদের এক টুকরো পাহাড়ের একদিকে এবং দ্বিতীয় টুকরো পাহাড়ের অপর দিকে চলে যায়। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮৬৪, সহীহ মুসলিম হা. ২৮০০)
ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে চন্দ্র বিদীর্ণ হয়ে দুই খন্ড হয়ে গেল। সবাই এ ঘটনা অবলোকন করল এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তোমরা ঈমান আনবে? তারা বলল : হ্যাঁ, তখন চন্দ্রোজ্জল রাত ছিল। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন বললেন : তোমরা সাক্ষী থেক। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮৬৫)
(وَإِنْ يَّرَوْا اٰيَةً يُّعْرِضُوْا)
‘তারা কোন নিদর্শন দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয়’ অর্থাৎ মক্কার কুরাইশরা কোন নিদর্শন দেখে ঈমান না এনে উল্টো ঈমান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিত। এর প্রমাণ তারা চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়া প্রত্যক্ষ করেছে অথচ ঈমানে আনেনি বরং আরো দূরে চলে গেছে। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে একত্রিত হয়ে বলল : তুমি যদি সত্যবাদী হও তাহলে চন্দ্র বিদীর্ণ করে দ্বিখন্ড কর। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে বললেন : আমি যদি এরূপ করতে পারি তাহলে কি তোমরা ঈমান আনবে? অতঃপর তারা ঈমান আনার অঙ্গীকার করলে তিনি তাঁর রবের কাছে এ মু’জিযাহ প্রার্থনা করলেন। ফলে চন্দ্র বিদীর্ণ হল, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুশরিকদেরকে আহ্বান করে বললেন : হে অমুক সাক্ষী থেক, হে অমুক সাক্ষী থেক। (দুররুল মানসূর ৭/৬৭১) এ সম্পর্কে সূরা আল আন‘আম-এর ৭ নম্বর আয়াতে আরো আলোচনা হয়েছে।
(سِحْرٌ مُّسْتَمِرٌّ)
‘বড় জাদু’ শব্দটি চলমান, দীর্ঘস্থায়ী। কিন্তু আরবি ভাষায় কোন সময় চলে যাওয়া, নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার অর্থে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ মুশরিকরা বলত, চন্দ্র বিদীর্ণ করা এমন একটা জাদু যা অচিরেই চলে যাবে। আরেকটি অর্থ হল : শক্ত ও কঠোর হওয়া। আবূল আলীয়া ও যহহাক এ তাফসীর করেছেন। অর্থাৎ এটা একটি বড় ও শক্ত জাদু। মক্কাবাসী যখন চাক্ষুষ দেখা অস্বীকার করতে পারল না তখন তারা এটা জাদু ও শক্ত জাদু বলে উড়িয়ে দিল।
(وَكُلُّ أَمْرٍ مُّسْتَقِرٌّ) - مُّسْتَقِرٌّ
অর্থ স্থির হওয়া, অর্থাৎ প্রত্যেক আমলকারীর আমল স্থির হয়ে আছে। কাতাদাহ্ (রহঃ) বলেন : এর অর্থ হলো : কল্যাণ ভাল লোকদের সাথে আর অকল্যাণ খারাপ লোকদের সাথে বিদ্যমান থাকবে। আর মুজাহিদ (রহঃ) বলেন : কিয়ামতের দিন প্রত্যেক কাজ স্থিতিশীল হবে।
الأنباء ‘সংবাদ’ বলতে পূর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিদের সংবাদকে বুঝানো হয়েছে।
مُزْدَجَرٌ অর্থাৎ পূর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিদের মাঝে উপদেশ ও শিক্ষা রয়েছে। কেউ যদি তাদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে শিরক ও পাপ থেকে বাঁচতে চায়, তাহলে সে বাঁচতে পারবে।
কিয়ামতের দিন যখন আমলনামা প্রকাশ করা হবে তখন ভাল মন্দ প্রত্যেক বিষয় তার হকদার ব্যক্তি পেয়ে যাবে। (তাফসীর মুয়াসসার)
(حِكْمَةٌ ۭبَالِغَةٌ)
অর্থাৎ এমন বাণী যা ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষাকারী।
(فَمَا تُغْنِ النُّذُرُ)
‘তবে সতর্ক বাণীসমূহ তাদের কোন কাজে আসেনি’ অর্থাৎ যার জন্য আল্লাহ তা‘আলা দুর্ভাগ্য লিখে দিয়েছেন এবং যার অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছেন নাবীদের ভীতি প্রদর্শন কি তার উপকারে আসতে পারে? আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
( قُلْ فَلِلہِ الْحُجَّةُ الْبَالِغَةُﺆ فَلَوْ شَا۬ئَ لَھَدٰٿکُمْ اَجْمَعِیْنَ)
“বল : ‘চূড়ান্ত প্রমাণ তো আল্লাহরই; তিনি যদি ইচ্ছা করতেন তবে তোমাদের সকলকে অবশ্যই সৎপথে পরিচালিত করতেন।” (সূরা আন‘আম ৬ : ১৪৯) সুতরাং যারা পূর্ববর্তী জাতির এসব ধ্বংসলীলা দেখেও ঈমান আনবে না, আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে চলবে না তাদের জন্য সুসংবাদ নয় বরং তারা নিজেরাই নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. কিয়ামত অতি নিকটে, সুতরাং জ্ঞানী সেই ব্যক্তি যে কিয়ামতের কঠিন মুহূর্ত থেকে বাঁচার জন্য সৎ আমল করে।
২. কিয়ামতের কয়েকটি আলামত জানতে পারলাম যা অতীত হয়ে গেছে। যেমন শেষ নাবীর আগমন, চাঁদ বিদীর্ণ হওয়া ইত্যাদি।
৩. প্রবৃত্তির অনুসারীরা নিন্দার পাত্র, এ কারণে তাদেরকে শাস্তি ভোগ করতে হবে।
৪. পূর্ববর্তী জাতিসমূহের ঘটনা বর্ণনা করার মাধ্যমে আমাদের সতর্ক করা হচ্ছে।
9 Fozlur Rahman
এ (কোরআন) এক পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান, তবে সতর্ককারীরা তাদের কোনই উপকারে আসে না।
10 Mokhtasar Bangla
৫. তাদের নিকট পূর্ণাঙ্গ প্রজ্ঞার কথা এসেছে যাতে তাদের উপর প্রমাণ সাব্যস্ত হয়। বস্তুতঃ যে জাতি আল্লাহ ও পরকাল দিবসে বিশ্বাসী নয় সতর্ক-সঙ্কেত তাদের কোন উপকারে আসবে না।
11 Tafsir Ibn Kathir
হযরত আবূ ওয়াকিদ (রঃ)-এর রিওয়াইয়াত পূর্বে গত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতরের নামাযে সূরায়ে قٓ ও اِقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ সূরায়ে পাঠ করতেন। অনুরূপভাবে বড় বড় মাহফিলেও তিনি এ দু'টি সূরা তিলাওয়াত করতেন। কেননা, এতে পুরস্কার ও শাস্তির প্রতিজ্ঞা, প্রথম সৃষ্টি ও মৃত্যুর পর পুনরুত্থান এবং এর সাথে সাথে তাওহীদ ও রিসালাত সাব্যস্তকরণ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর বর্ণনা রয়েছে।
১-৫ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা'আলা কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়া এবং দুনিয়া শেষ হয়ে যাওয়ার খবর দিচ্ছেন। যেমন তিনি বলেছেনঃ اَتٰى اَمْرُ اللهِ فَلَا تَسْتَعْجِلُوْهُ অর্থাৎ “আল্লাহর আদেশ (কিয়ামত) আসবেই; সুতরাং তা ত্বরান্বিত করতে চেয়ো না।” (১৬:১) আরো বলেনঃ اِقْتَرَبَ لِلنَّاسِ حِسَابُهُمْ وَ هُمْ فِیْ غَفْلَةٍ مُّعْرِضُوْنَ অর্থাৎ মানুষের হিসাব নিকাশের সময় আসন্ন, কিন্তু তারা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে রয়েছে।” (২১:১) এই বিষয়ের উপর বহু হাদীসও বর্ণিত হয়েছে।
হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় সাহাবীদের সামনে ভাষণ দান করেন। ঐ সময় সূর্য অস্তমিত হতে অতি অল্প সময় বাকী ছিল। ভাষণে তিনি বলেনঃ “যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তার। শপথ! অতীত যুগের তুলনায় দুনিয়ার হায়াতও এই পরিমাণ বাকী আছে যে পরিমাণ সময় এই দিনের বাকী আছে দিনের গত হয়ে যাওয়া সময়ের তুলনায়। সূর্যের তো আমরা সামান্য অংশই দেখতে পাচ্ছি।” (এ হাদীসটি হাফিয আবু বকর আল বাযযার (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এ হাদীসের বর্ণনাকারীদের মধ্যে হযরত খালফ ইবনে মূসা (রঃ)-কে ইমাম ইবনে হিব্বান (রঃ) বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনাকারীদের মধ্যে গণ্য করেন বটে, কিন্তু বলেন যে, তিনি কখনো কখনো কখনো ভুলও করে থাকেন। দ্বিতীয় রিওয়াইয়াতটি একে সবল করে। এমন কি এর ব্যাখ্যা করে)
হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আসরের পর যখন সূর্য ডুবু ডুবু প্রায়, তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “অতীত যুগের লোকদের বয়সের তুলনায় তোমাদের বয়স ততটুকু যতটুকু এই বাকী সময়, এই দিনের গত হয়ে যাওয়া সময়ের তুলনায়। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত সাহল ইবনে সা'দ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি ও কিয়ামত এই ভাবে প্রেরিত হয়েছি।” অতঃপর তিনি তর্জনী ও মধ্যমা অঙ্গুলী দ্বারা ইশারা করেন। অন্য রিওয়াইয়াতে এটুকু বেশী আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “কিয়ামত আমা হতে বেড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।” (এ হাদীসটিও ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) হযরত আবু হাফিয সালমা ইবনে দীনার (রঃ)-এর হাদীস হতে এটা তাখরীজ করেছেন)
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) ওয়ালিদ ইবনে আবদিল মালিকের নিকট পোঁছলে তিনি তাঁকে কিয়ামত সম্বলিত হাদীসটি জিজ্ঞেস করেন। তিনি উত্তরে বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছিঃ “তোমরা ও কিয়ামত এ দু'টি অঙ্গুলির মত।” এর সাক্ষ্য এ হাদীস দ্বারাও হতে পারে, যার মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মুবারক নামগুলোর মধ্যে একটি নাম হাশির এসেছে। আর হাশির হলেন তিনি যার পদদ্বয়ের উপর জনগণের হাশর হবে।
হযরত বাহায (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত উৎবা ইবনে গাওয়ান (রাঃ) স্বীয় ভাষণে বলেন এবং কখনো বলতেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদের সামনে ভাষণ দিতে গিয়ে আল্লাহ তা'আলার হামদ ও সানার পর বলেনঃ “দুনিয়া শেষ হয়ে যাওয়ার ঘোষণা হয়ে গেছে। এটা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পালিয়ে যাচ্ছে। যেমন পাত্রের খাদ্য খেয়ে নেয়া হয় এবং ধারে কিছু লেগে থাকে, দ্রুপ দুনিয়ার বয়সের সমস্ত অংশই বেরিয়ে পড়েছে, শুধু নামে মাত্র বাকী আছে। তোমরা এখান হতে এমন জগতের দিকে গমনকারী যা কখনো ধ্বংস হবার নয়। সুতরাং সম্ভব হলে তোমরা এখান হতে কিছু পুণ্য সাথে নিয়ে যাও। জেনে রেখো, আমাদের কাছে বর্ণনা করা হয়েছে যে, জাহান্নামের ধার হতে একটি পাথর নিক্ষেপ করা হবে যা সত্তর বছর ধরে নীচের দিকে অনবরত নামতে থাকবে, তবুও ওর তলা পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না। আল্লাহর শপথ! জাহান্নামের এই গভীর গর্ত মানুষ দ্বারা পূর্ণ করা হবে। তোমরা এতে বিস্ময় প্রকাশ করো না। আমাদের কাছে এও বর্ণনা করা হয়েছে যে, জান্নাতের চৌকাঠের দুটি কাঠের মধ্যবর্তী ব্যবধান চল্লিশ বছরের পথ। আর এটাও একদিন এমনভাবে পূর্ণ হয়ে যাবে যে, খুবই ভীড় দেখা যাবে (শেষ পর্যন্ত)।
আবু আবদির রহমান সালমী (রঃ) বলেনঃ “আমি আমার পিতার সাথে মাদায়েনে গমন করি। জনপদ হতে তিন মাইল দূরে আমরা অবস্থান করি। জুমআর নামাযের জন্যে আমিও আমার পিতার সাথে গমন করি। হযরত হুযাইফা (রাঃ) মসজিদের খতীব ছিলেন। তিনি খুত্বায় বলেনঃ “হে জনমণ্ডলী! জেনে রেখো যে, আল্লাহ তা'আলা বলেছেনঃ “কিয়ামত আসন্ন, চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে। কিয়ামত নিকটে এসে গেছে এবং অবশ্যই চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হয়েছে। নিশ্চয়ই দুনিয়া বিচ্ছিন্নতার সতর্কধ্বনি করেছে। আজকের দিনটি হলো চেষ্টা ও প্রস্তুতির দিন। আগামী কাল তো হবে দৌড়াদৌড়ি করে আগে বেড়ে যাওয়ার দিন।” আমি আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করলামঃ কালকে দৌড় হবে কি যাতে আগে বেড়ে যেতে হবে? তিনি উত্তরে আমাকে বললেনঃ “তুমি তো একেবারে অজ্ঞ ছেলে! এখানে একথার দ্বারা আমলের দিক দিয়ে একে অপরের আগে বেড়ে যাওয়া বুঝানো হয়েছে। দ্বিতীয় জুমআর দিন যখন আমরা আসলাম তখন হত হুযাইফা (রাঃ)-কে প্রায় আগের জুমআর দিনের মতই ভাষণ দিতে শুনলাম। শেষে তিনি একথাও বললেনঃ “পরিণাম হলো আগুন। سَابِق হলো ঐ ব্যক্তি যে জান্নাতে সর্বপ্রথম পৌঁছে গেল।”
আল্লাহ তাআলার উক্তি - ‘চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে।' এটা নবী (সঃ)-এর যুগের ঘটনা। যেমন মুতাওয়াতির হাদীসসমূহে বিশুদ্ধতার সাথে এটা বর্ণিত হয়েছে। সহীহ হাদীসে হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ “পাঁচটি জিনিস গত হয়েছে। (এক) রূম, (দুই) ধূম্র, (তিন) লিম, (চার) বাশাহ এবং (পাঁচ) চন্দ্র বিদীর্ণ হওন।”
এ সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসসমূহ :
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, মক্কাবাসী নবী (সঃ)-এর কাছে মু'জিযা দেখানোর আবেদন জানালো। ফলে দুই বার চন্দ্র বিদীর্ণ হয়, যার বর্ণনা এই আয়াত দু’টিতে রয়েছে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতেই বর্ণিত আছে যে, মক্কাবাসী রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে মু'জিযা দেখাবার আবেদন করলে তিনি চন্দ্রকে দ্বিখণ্ডিত করে তাদেরকে দেখিয়ে দেন। সুতরাং তারা হিরার এদিকে এক খণ্ড এবং ওদিকে এক খণ্ড দেখতে পায়।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত জুবায়ের ইবনে মুতইম (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর যুগে চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হয়। এক খণ্ড এক পাহাড়ে এবং অপর খণ্ড অন্য পাহাড়ে পতিত হয়। তখন তারা বলেঃ “মুহাম্মাদ (সঃ) আমাদের উপর যাদু করেছে।” তখন জ্ঞানীরা বললোঃ “যদি এটা মেনে নেয়া হয় যে, তিনি আমাদের উপর যাদু করেছেন তবে তিনি তো সমস্ত মানুষের উপর যাদু করতে পারেন না।” [এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম আহমাদ (রঃ)]
অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, এটা হিজরতের পূর্বের ঘটনা। আরো বহু রিওয়াইয়াত রয়েছে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে এটাও বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর যুগে চন্দ্র গ্রহণ হলে কাফিররা বলতে শুরু করে যে, চন্দ্রের উপর যাদু করা হয়েছে। তখন اِقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانْشَقَّ الْقَمَرُ হতে مُسْتَمِرٌّ পর্যন্ত আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়।
হযরত ইবনে উমার (রাঃ) বলেন যে, যখন চন্দ্র বিদীর্ণ হয় এবং ওর দু'টি টুকরো হয়, একটি পাহাড়ের পিছনে এবং অপরটি পাহাড়ের সামনে, ঐ সময় নবী (সঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন।” (সহীহ মুসলিম, জামে তিরমিযী প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থে এ হাদীসটি বিদ্যমান রয়েছে)
হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর যুগে চন্দ্র বিদীর্ণ হয় এবং ওটা দুই ভাগে বিভক্ত হয়। জনগণ ভালভাবে তা লক্ষ্য করে। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “তোমরা সাক্ষী থাকো।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ “ঐ সময় আমরা মক্কায় ছিলাম।”
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর যুগে চন্দ্র বিদীর্ণ হয়। তখন কুরায়েশরা বলেঃ “ইবনে আবি কাবৃশাহর (অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সঃ-এর) এটা যাদু।” কিন্তু তাদের জ্ঞানী লোকেরা বলেঃ “যদি এটা মেনে নেয়াই হয় যে, তিনি আমাদের উপর যাদু করেছেন, কিন্তু দুনিয়ার সমস্ত লোকের উপর তো তিনি যাদু করতে পারেন না? এখন যারা সফর থেকে আসবে তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হোক যে, তারাও ঐ রাত্রে চন্দ্রকে বিদীর্ণ হতে দেখেছে কি না?” অতঃপর যখন তারা ফিরে আসলো তখন তারাও এটা স্বীকার করলো যে, সত্যি তারা ঐ রাত্রে চন্দ্রকে দ্বিখণ্ডিত হতে দেখেছে। কাফিরদের সমাবেশে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো যে, যদি বাহিরের লোক এসে একথাই বলে তবে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সত্যতায় সন্দেহ করার কিছুই থাকবে না। অতঃপর যখন বাহির হতে লোক আসলো এবং যেখান হতেই আসলো সবাই এই সাক্ষ্য দান করলো যে, তারা স্বচক্ষে চন্দ্রকে দ্বিখণ্ডিত হতে দেখেছে। এরই বর্ণনা এই আয়াতে রয়েছে।
হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন যে, চন্দ্রের দুই খণ্ডের মধ্যে পাহাড় দেখা যেতো। অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হলে হযরত আবূ বকর (রাঃ)-কে নবী (সঃ) বলেনঃ “হে আবু বকর (রাঃ)! তুমি সাক্ষী থাকো।” আর মুশরিকরা এই বিরাট মু'জিযাকেও যাদু বলে দিয়ে দূরে সরে গিয়েছিল। এরই বর্ণনা এই আয়াতে রয়েছে যে, তারা বলেঃ এটা তো চিরাচরিত যাদু। এই বলে তারা তা প্রত্যাখ্যান করে। তারা সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে নবী (সঃ)-এর হুকুমের বিপরীত নিজেদের কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে। তারা নিজেদের অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতা হতে বিরত থাকে না।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ আর প্রত্যেক ব্যাপারই লক্ষ্যে পৌঁছবে। অর্থাৎ ভাল ভালদের ও মন্দ মন্দদের সাথে। এও বলা হয়েছে যে, এর অর্থ হলোঃ কিয়ামতের দিন প্রত্যেক ব্যাপারই সংঘটিত হবে।
মহান আল্লাহ বলেনঃ তাদের নিকট এসেছে সুসংবাদ, যাতে আছে সাবধান বাণী; এটা পরিপূর্ণ জ্ঞান, তবে এই সতর্কবাণী তাদের কোন উপকারে আসেনি। আল্লাহ তা'আলা যাকে হিদায়াত করেন এবং যাকে পথভ্রষ্ট করেন, এতেও তাঁর পরিপূর্ণ নিপুণতা বিদ্যমান রয়েছে। তারা যে হতভাগ্য এটা তাদের ভাগ্যে লিখে দেয়া হয়েছে। যাদের অন্তরে মোহর মেরে দেয়া হয়েছে তাদেরকে কেউই হিদায়াত দান করতে পারে না। এ আয়াতটি আল্লাহ তাআলার নিম্নের উক্তির মতঃ
قُلْ فَلِلّٰهِ الْحُجَّةُ الْبَالِغَةُ فَلَوْ شَآءَ لَهَدٰىكُمْ اَجْمَعِیْنَ
অর্থাৎ “ (হে নবী সঃ)! তুমি বলে দাও আল্লাহর যুক্তি সবদিক দিয়েই পরিপূর্ণ, তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদের সকলকেই হিদায়াত দান করতে পারতেন।” (৬:১৪৯) অনুরূপ নিম্নের উক্তিটিওঃ
وَ مَا تُغْنِی الْاٰیٰتُ وَ النُّذُرُ عَنْ قَوْمٍ لَّا یُؤْمِنُوْنَ
অর্থাৎ “বেঈমানদেরকে কোন মু'জিযা এবং কোন ভয় প্রদর্শনকারী কোন উপকার পৌঁছায় না।” (১০:১০১)